Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

মোদীর গত পাঁচ দিনের বক্তব্যের ফ্যাক্টচেক: মিথ্যের ফুলঝুরি

Icon

আউটলুক ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১৬ এএম

মোদীর গত পাঁচ দিনের বক্তব্যের ফ্যাক্টচেক: মিথ্যের ফুলঝুরি

ছবি: স্ক্রোল ইন থেকে নেওয়া

ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোট সাত দফায় দেশটির প্রায় ১০০ কোটি মানুষ ভোট দেবেন। প্রথম দফা ভোট হয় গত ১৯ এপ্রিল। আর দ্বিতীয় দফার ভোট হয় ২৬ এপ্রিল। ১ জুন শেষ দফা ভোটগ্রহণের পর আগামী ৪ জুন ভোটের ফলাফল প্রকাশ করা হবে। এই নির্বাচনের প্রচারে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্যে ধর্মীয়বিদ্বেষ ভাব এবং মিথ্যার ফুলঝুরি প্রকাশ পেয়েছে। এ জন্য তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে মোদী তার বক্তব্যে লাগাম টানেননি।
 
স্ক্রোল ইন-এ প্রকাশিত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী প্রচারণায় মিথ্যার ফুলঝুরি এবং ফ্যাক্টচেক বাংলা আউটলুকের পাঠাকদের জন্য অনুবাদ করা হলো....

২১ এপ্রিল, রাজস্থানের বাঁশওয়াড়ায় নির্বাচনী প্রচারণায়
এদিন মোদী দাবি করেন, কংগ্রেসের ইশতেহারে বলা হয়েছে, বিবাহিত হিন্দু নারীদের মঙ্গলসূত্রসহ ব্যক্তিগত সম্পদ জরিপ করে বাজেয়াপ্ত করা হবে। পরে সেগুলো পুনর্বণ্টন করা হবে। মোদী বলেন, ‘আমার মা ও বোনদের সোনার গয়না শুধু একটি শোপিস নয়, এটি তাঁদের আত্মসম্মানের সঙ্গে জড়িত। মঙ্গলসূত্র তাঁদের জীবনের সঙ্গে জড়িত। আর আপনি ইশতেহারে এটি কেড়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন?"

ফ্যাক্ট: কংগ্রেসের ইশতেহারে ব্যক্তিগত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তাছাড়া বিবাহিত নারীদের মঙ্গলসূত্র বাজেয়াপ্ত করার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই।  

মোদী আরও দাবি করেন, এর আগে যখন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস সরকার তখন দেশের সম্পদের প্রথম অধিকার মুসলমানদের বলে ঘোষণা দিয়েছিল। 

ফ্যাক্ট: এখানে মোদী ২০০৯ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের দেওয়া একটি বক্তব্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছনে। মনমোহন সিং তখন শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, তালিকাভুক্ত সম্প্রদায়সহ অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণি, নারী এবং শিশুসহ ভারতের সব সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিল।

মোদী সেই দিন ভারতীয় মুসলমানদের ইঙ্গিত করে আরও দাবি করেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে ব্যক্তিগত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ‘অনুপ্রবেশকারী’ (মুসলমানদের) এবং যাদের একাধিক সন্তান আছে তাদের মধ্যে বিতরণ করে দেবে।

ফ্যাক্ট: মুসলমানেরা ভারতে অনুপ্রবেশকারী মোদীর এই দাবির কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। খোদ মোদী সরকার বারবার সংসদকে বলেছে, তাদের কাছে অবৈধ অভিবাসীদের কোনো তথ্য নেই। আর ভারতীয় মুসলমানদের প্রজনন হার হিন্দুদের তুলনায় বেশি, তবে অন্য সব সম্প্রদায়ের তুলনায় এ হার দ্রুত কমছে। এছাড়া প্রজননের সঙ্গে অর্থনৈতিক অবস্থা জড়িত, ধর্ম নয়। তবে বিহারের হিন্দুদের তুলনায় তামিলনাডুতে মুসলমানদের প্রজনন হার কম।

২২ এপ্রিল, আলিগড়ে নির্বাচনী প্রচারণায়
এদিনও মোদী আগের দাবির পুনরাবৃত্তি করেন। এদিন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে 'কংগ্রেসের শেহজাদ উল্লেখ কারে মোদী বলেন, 'তিনি (রাহুল গান্ধী) এবং তাদের ইশতেহারে এটাই বলা হয়েছে, দল ক্ষমতায় এলে আপনার আয়, সম্পদ, বাড় সম্পর্কে জানতে একটি সমীক্ষা চালানো হবে। এরপর সেসব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং পুনর্বণ্টন করা হবে।

ফ্যাক্ট: কংগ্রেসের ইশতেহারে এমন কিছুর বলা হয়নি। নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশের সময় ৬ এপ্রিল রাহুল গান্ধী বলেছিল, ‘আমরা দেশের সমীক্ষা করবো। পিছিয়ে পড়া, দলিত, আদিবাসী, সাধারণ দরিদ্র মানুষ এবং সংখ্যালঘুরা জানতে পারবে, দেশে তাদের অংশ কী। সেখানে ব্যক্তিগত সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং পুনর্বণ্টন করবে এমন কিছু বলা হয়নি।

এছাড়া নরেন্দ্র মোদীর দাবি: কারও যদি গ্রামে পৈতৃক বাড়ি থাকে এবং তাঁর সন্তানদের জন্য শহরে ছোট ফ্ল্যাট কেনেন, তবে কংগ্রেস যেকোনো মালিকানা বাজেয়াপ্ত করবে। মোদী বলেন, এটা কী মাওবাদী চিন্তা নয়? কংগ্রেস আপনার কষ্টার্জিত সম্পদ ছিনিয়ে নিতে চায়, নারীদের সম্পত্তি লুট করতে চায়।

ফ্যাক্ট: কংগ্রেসের ইশতেহারে সম্পত্তি পুনর্বণ্টনের একমাত্র উল্লেখটি হলো, ক্ষমতায় এলে তারা এর জন্য একটি যথাযথ কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ নেবে। যার মাধ্যমে সরকারি জমি এবং সর্বোচ্চ ভূসম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কিত আইনের (ভূমি সিলিং আইন) অধীনে উদ্বৃত্ত জমি দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টনের বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। কংগ্রেসের এই উদ্যোগ নতুন কিছু নয়। কারণ, এরই মধ্যে ভারতের ২১টি রাজ্যে ভূমি সিলিং আইন রয়েছে। ১৯৬০ সালে এটি জমির মালিকানা বৈষম্য দূর করার জন্য প্রণয়ন করা হয়।

২৩ এপ্রিল, টঙ্ক-সাওয়াই মধুপুরে নির্বাচনী প্রচারণায়
এদিন মোদীর দাবি: কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, আপনার বাড়ির গোলায় যদি খেতের শস্য সংরক্ষণ করেন সেটির সমীক্ষা হবে। আপনার সমস্ত সম্পত্তি আপনার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি, তা বাজেয়াপ্ত করে বিতরণ করে দেওয়া হবে। যদি আপনার দুটি বাড়ি থাকে আর সেটি তাদের সমীক্ষা উঠে আসলে সরকার একটি বাড়ি দখল করবে। এটা কি আপনি মেনে নেবেন?  

ফ্যাক্ট: কংগ্রেসের ইশতেহারে বা দলের নেতারা কখনো সরকার গঠন করলে জনগণের বাড়ি দখল এবং পুনর্বণ্টনের উদ্যোগ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। 

২৪ এপ্রিল, সাগরে (মধ্য প্রদেশ) নির্বাচনী প্রচারণায়
এদিন মোদী দাবি করেন, কর্নাটকে কংগ্রেস ধর্মের ভিত্তিতে অবৈধভাবে ওবিসি কোটায় বা অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য রাখা কোটায় মুসলিম সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করে অন্যদের জন্য কোটা কমিয়ে ফেলেছে।

ফ্যাক্ট: ঘটনাটি ১৯৬২ সালের। ওই সময় কর্ণাটকের কংগ্রেস সরকার ধর্মের ভিত্তিতে নয়, বরং নাগানা গৌড়া কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু অংশকে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের শ্রেণিবিন্যাস এবং এটি সংরক্ষণের মানদণ্ড নির্ধারণের জন্য ওই সময় একটি প্যানেলও গঠন করা হয়। এ ছাড়া কংগ্রেসেরও অনেক আগে মহীশূরের মহারাজা ১৯২১ সালে মুসলিম কোটা সংরক্ষণ নীতি প্রবর্তন করেন। পরে ১৯৯৪ সালে এইচডি দেবগৌড়ার নেতৃত্বাধীন জনতা দল (ধর্মনিরপেক্ষ) সরকার কর্ণাটকের পুরো মুসলিম সম্প্রদায়কে ওবিসি তালিকার অধীনে নিয়ে আসে এবং তাদের জন্য ৪ শতাংশ উপকোটা তৈরি করে। জনতা দল (ধর্মনিরপেক্ষ) বর্তমানে বিজেপির মিত্র।

প্রসঙ্গত, কর্ণাটক হলো ভারতের ১৪টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়কে শতভাগ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার ভিত্তিতে ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া গুজরাট, যেখানে মোদী ১২ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, সেখানেও ওবিসি কোটায় মুসলিম সম্প্রদায়ের নাম রয়েছে। দুই বছর আগে বার্তা সংস্থা এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মোদী গর্ব করে বলেছিলেন যে, তাঁর রাজ্যে প্রায় ৭০টি মুসলিম পরিবার এই সুবিধা পেয়ে উন্নতি করেছে।

২৪ এপ্রিল, সুরগুজায় (ছত্রিশগড়) নির্বাচনী প্রচারণায়
মোদী দাবি করেন, কংগ্রেস প্রথম অন্ধ্র প্রদেশে ধর্মের ভিত্তিতে কোটা বাস্তবায়ন এবং সারা দেশে একই কোটা প্রয়োগ করার পরিকল্পনা করেছিল। তারা ধর্মের ভিত্তিতে ১৫ শতাংশ কোটার প্রস্তাব করেছিল। মোদী আরও দাবি করেন, 'কংগ্রেস আরও প্রস্তাব করেছিল, কিছু মানুষকে তালিকাভুক্ত সম্প্রদায় এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্ রাখা কোটা কমিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে কোটার সুযোগ দেওয়া উচিত। কংগ্রেস ২০০৯ সালে ইশতেহারে এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিল। ২০১৪ সালের ইশতেহারেও তারা স্পষ্টভাবে এটি বাস্তবায়নের কথা বলেছিল।

ফ্যাক্ট: অন্ধ্র প্রদেশের কংগ্রেস সরকার ২০০৫ সালে একটি আইন পাস করে, যেখানে মুসলিমদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হাইকোর্ট আইনটিকে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দেয়। ওই সময় হাইকোর্টের যুক্তি ছিল, ধর্ম 'সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া নাগরিকদের শ্রেণি নির্ধারণের একমাত্র ভিত্তি' হতে পারে না। ২০০৯ সালের ইশতেহারে কংগ্রেস সতর্কতা অবলম্বন করে বলেছিল, তারা সংখ্যালঘুদের জন্য 'তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার ভিত্তিতে' কোটা রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

মোদী আবার দাবি করেন, কংগ্রেস কর্ণাটকে ধর্মের ভিত্তিতে কোটা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু যখন বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলো, আমরা কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছিলাম। যা সংবিধান এবং বাবাসাহেব আম্বেদকরের আদর্শের বিরুদ্ধে ছিল এবং দলিত ও আদিবাসীদের তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।

ফ্যাক্ট: ২০২৪ সালের মার্চে, কর্ণাটকের বিজেপি সরকার মুসলিম অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য ৪ শতাংশ উপকোটা বাতিল করে। কিন্তু দলিত ও আদিবাসীদের জন্য কোটা পুনর্বণ্টন করেনি।

মোদী আরও দাবি করেন, কংগ্রেস বলছে, তারা উত্তরাধিকার কর আরোপ করবে, এমনকি পিতামাতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের ওপরও কর আরোপ করবে। আপনার জমানো সম্পদ আপনার সন্তানেরা পাবে না এবং কংগ্রেস আপনার কাছ থেকে তা কেড়ে নেবে।'
ফ্যাক্ট: কংগ্রেসের ইশতেহারে উত্তরাধিকার করের কোনো উল্লেখ নেই।


২৪ এপ্রিল, বেতুলে (মধ্য প্রদেশ) নির্বাচনী প্রচারণায়
মোদী দাবি করেছেন, কংগ্রেস তালিকাভুক্ত সম্প্রদায়, ওবিসি গোষ্ঠীগুলোর কোটা কেড়ে নিতে চায় এবং দলটি নিজেদের ভোট ব্যাংক শক্তিশালী করতে ব্যক্তিগত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার এবং পুনরায় বিতরণ করার ষড়যন্ত্র করছে।

ফ্যাক্ট: কংগ্রেসের ইশতেহারে ধর্মভিত্তিক কোটা বা সম্পদের পুনর্বণ্টনের কোনো উল্লেখ নেই।


২৫ এপ্রিল, আগ্রায় নির্বাচনী প্রচারণায়
মোদী দাবি করেন, কংগ্রেস ধর্মের ভিত্তিতে কোটা দেওয়ার জন্য ওবিসি বা পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত ২৭ শতাংশ কোটার একটি অংশ 'চুরি' করার পরিকল্পনা করেছে।

ফ্যাক্ট: কংগ্রেসের ইশতেহারে ধর্মভিত্তিক কোটা সংরক্ষণের কোনো উল্লেখ নেই।

২৫ এপ্রিল, আওনলায় (উত্তর প্রদেশ) নির্বাচনী প্রচারণায়
এদিন মোদী নতুন করে আবার দাবি করেন, ‘শুধু অর্থনৈতিক সমীক্ষা নয়, কংগ্রেসের লক্ষ্য সব প্রতিষ্ঠান ও অফিস সমীক্ষা করা। যদি কোথাও পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বা দলিত পরিবারের দুজন সদস্যকে চাকরিরত পাওয়া যায়, তাহলে কংগ্রেস একজনের চাকরি কেড়ে নেবে এবং যাদের তারা মনে করে দেশের সম্পদের প্রথম দাবিদার (মুসলিমান) তাদের দেবে। 

ফ্যাক্ট: কংগ্রেসের ইশতেহারে বা দলটির নেতারা পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বা দলিত পরিবারের চাকরি কেড়ে নেওয়ার কথা বলেনি।

অনুসরণ করুন