Logo
Logo
×

খেলা

খেলাধুলায় নারীর প্রতি সহিংসতা সর্বত্র

Icon

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৫০ পিএম

খেলাধুলায় নারীর প্রতি সহিংসতা সর্বত্র

স্প্যানিশ ফুটবলের আলোচিত চুমু কাণ্ড। ছবি: সংগৃহীত

খেলাধুলায় নারীর প্রতি সহিংসতা যেন সাধারণ ব্যাপার। বিশ্বের সব স্থানেই এই সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পাশ্চাত্যের কথিত আধুনিক সমাজে যেমন নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ আছে, আপাত পিছিয়ে থাকা প্রাচ্যেও তেমনি আছে। মোদ্দকথা নারীকে কোনোভাবে পুরুষের সমান হতে দেওয়া যাবে না। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবই এর জন্য দায়ী। 

খেলাধুলায় নারীদের প্রতি হওয়া নির্যাতন-নিপীড়ন নিয়ে গবেষণা করছেন অস্ট্রেলিয়ার লা ট্রোব ইউনিভার্সিটির লা ট্রোব রোরাল হেল্থ স্কুলের রিসার্চ ফেলো ফিওনা জাইলস এবং প্রিন্সিপাল রিসার্চ ফেলো অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর কার্স্টি ফরসডাইক। এ সংক্রান্ত তাদের যৌথভাবে লেখা আর্টিকেল দ্য কনভারসেশন ডটকমে প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করে তা বাংলা আউটলুকে তুলে দেওয়া হলো।  

স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক প্রধান লুইস রুবিয়ালেস স্প্যানিশ ফুটবল তারকা জেনি হারমোসোকে জোর করে চুমু দিয়েছেন। আর এর জন্য তিনি হয়তো কঠিন পরিণতি ভোগ করতে পারেন। কিন্তু খেলাধুলায় লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংস অপরাধীদের জন্য সেই পরিণতি কোনো আদর্শ শাস্তির ঘটনা হবে বলে মনে হয় না। কারণ খেলাধুলায় এই ধরনের সহিংসতা সম্পর্কিত নারীদের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২৫ বছরের গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব অপরাধীদের খুব কমই জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়েছে। 

আরও সাধারণভাবে বললে, অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং এই দায়মুক্তিতেই ভুক্তভোগীদের সঙ্গে অবাধে খারাপ আচরণ করেন অপরাধীরা। এমনকি লাখ লাখ লোকের সামনেই রুবিয়ালসে ওই কাণ্ড ঘটালেও হারমোসোকে প্রথমে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। বরং সংশ্লিষ্ট শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ তাকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করেছিল, চুমু কাণ্ডটি তার সম্মতিতেই ঘটেছে। যদিও ঘটনার পর লাখো নারী হারমোসোর পাশে দাঁড়ায় এবং ঘটনাটি যে তার সম্মতিতে হয়নি তা প্রকাশে সাহস যোগায়। 

খেলাধুলায় লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার দুর্বিষহ বাস্তবতা
নারীদের খেলাধুলাকে ক্ষমতায়ন এবং সমতার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু পূর্ববর্তী বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, নারীদের খেলাধুলায় লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা খুবই প্রচলিত একটি ব্যাপার। এমনকি সহিংসতাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত ও পরিমাপ করা হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে ক্ষেত্র বিশেষে মানসিক, শারীরিক এবং যৌন সহিংসতার এই হার ২৬ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত গড়িয়েছে।

খেলাধুলায় নারী নির্যাতনের ঐতিহাসিক এবং সমসাময়িক অনেক ঘটনা ঘটেছে। সেসব ঘটনায় দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলে অপরাধীরা কীভাবে এতদিন ধরে তাদের এই নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে গেছে তা নিয়ে উদ্বেগই তৈরি হয়। 

খেলাধুলায় লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাগুলো আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য এবং ভবিষ্যতে প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়ার পথ তৈরির জন্য, গবেষণায় পদ্ধতিগতভাবে ভুক্তভোগী অনেক নারীর অভিজ্ঞতা একত্রিত করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বর্তমান এবং সাবেক খেলোয়াড়, কোচ, আম্পায়ার এবং ম্যানেজাররাও ছিলেন।  

দেখা গেছে, খেলাধুলায় নারীরা একাধিক ধরনের সহিংসতার (যৌন, শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক, আর্থিক) শিকার হন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীর সংখ্যা একের অধিক থাকেন। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে পরিচিত অপরাধী হলেন কোচ বা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এরপরই আছেন পুরুষ খেলোয়াড় বা সাধারণ মানুষ। 

আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো খেলাধুলার প্রেক্ষাপটে এই সহিংস আচরণগুলিকে ‘স্বাভাবিককরণ’ করা হয় এবং তাদের জন্য এসবকে খুবই প্রত্যাশিত ভাবা হয়। আর নিয়মিতভাবেই এসব ঘটনার বিচার চাওয়াকে অজুহাত মনে করা হয়।

'খেলাধুলার পারিবারিক সহিংসতা' থেকে সাবধান
গবেষণায় দেখা গেছে, যখন নারীরা নিপীড়ন-নির্যাতনের ব্যাপারে মুখ খুলেন এবং অভিযোগ করেন, তখন তার সাংগঠনিক প্রতিক্রিয়াগুলি খুবই অকার্যকর, বিদ্বেষপরায়ণ এবং নিষ্ঠুর হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অভিযোগগুলো কোনো গুরুত্ব পায়নি। এমনকি আচরণবিধিও না থাকতে পারে এবং কোনো ধরনের গোপনীয়তাও অবলম্বন করা হয়নি। কারণ ‘সবাই সবাইকে জানে’। 

শুধু তাই নয়, কিছু ক্ষেত্রে নারীদের উপহাস করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল তারা কল্পনায় নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এটি সংস্থাগুলোর ইচ্ছাকৃত কৌশল যেখানে নারীদের নিরাপত্তা নয়, আগে তাদের ‘সাফল্য’ এবং ‘জয়’। তাই নারীদের নিজেকেই নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল, কিংবা খেলাই ছেড়ে দিতে হয়েছিল।

কখনও কখনও ন্যায়বিচার পাওয়া গেছে, যখন নারীরা তাদের বাজে অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়তে সংঘবদ্ধ হয়েছিল এবং নির্যাতনকারীদের মোকাবিলা করেছিল। গবেষণায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রেক্ষাপট সামনে এসেছে তা হলো, খেলতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে পারিবারিক আবহের সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। অনেকটা বর্ধিত পরিবারের সদস্যের মতো পরস্পর সময় পার করেন। অর্থাৎ খেলোয়াড়রা তাদের কোচ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সতীর্থদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ান। যাকে বলা হয় ক্রীড়া পরিবার। আর এই পারিবারিক আবহই নির্যাতনের পরিস্থিতি তৈরি করে।

কোচকে বাবার সমতুল্য ভাবা
বেশ কয়েকটি গবেষণায় কোচকে বাবার মতো বিবেচনা করা হয়েছিল। কিছু খেলোয়াড় বলেছেন, কোচ তাদের সম্পর্কে বাবা-মায়ের চেয়ে বেশি জানেন।

যদি কোনো কোচকে ‘সেরা’ বিবেচনা করা হয়, তবে তাকে প্রায় কেউই প্রশ্ন করে না। আর এই মনোভাবই কোচদের লাগামহীন ক্ষমতা দেয়। এই ক্ষমতায়ই তারা নির্যাতিত নারী খেলোয়াড়দের খেলা সংশ্লিষ্ট পরিবার এবং নিজের প্রকৃত পরিবার—উভয় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ব্যবহার করেন। গোপনীয়তা ও আধিপত্যের পরিবেশ ধরে রাখতে তিনি জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। 

দেখা গেছে, পুরুষদের তুলনায় এখনো নারীদের নগন্য মনে করা হয় এবং খেলাধুলার প্রেক্ষাপটে নারীরা ‘অন্য’ হিসেবে বিবেচিত হন। ফলে নারীদের প্রতি বৈরিতা আছে এবং তাদেরকে খেলাধুলায় আধিপত্যবাদী পুরুষত্বের জন্য হুমকি মনে করা হয়।

ইতিবাচকতা আছে, আরও প্রয়োজন
পরিবর্তনের কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত আছে। যেমন অস্ট্রেলিয়ায় নারী সাঁতারুদের নির্যাতনের সংস্কৃতি নিয়ে সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। এখন তা কার্যকর করা হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কোচদের সম্পর্ক রাখা নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। এছাড়াও নারী খেলোয়াড়দের রক্ষায় বেশ কয়েকটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ কাজ করছে। যেমন দ্য আর্মি অব সারভাইভারস, স্পোর্টস অ্যান্ড রাইটস অ্যালায়েন্স এবং জিমন্যাস্টস ফর চেঞ্জ। মোট কথা হলো ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য সমষ্টিগতভাবে কাজ করতে হবে। 

সবশেষে বলা যায়, রুবিয়েলসের কাণ্ডের নিন্দা এবং জেনি হারমোসোর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে। আবার খেলাধুলার জগতে অনেক নারীর কণ্ঠই হয়তো এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে না। কিন্তু তাতে কি, এও তো দুঃখজনক যে, তিনি এমন জায়গায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন যাকে তিনি নিজের পরিবার মনে করতেন। 

অনুসরণ করুন