Logo
Logo
×

অভিমত

ফরিদপুরের ঘটনাকে আমরা কীভাবে বুঝবো

Icon

সহুল আহমদ

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:০৫ পিএম

ফরিদপুরের ঘটনাকে আমরা কীভাবে বুঝবো

গত ১৮ এপ্রিল ফরিদপুরের মধুখালিতে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। মন্দিরে আগুন দিয়েছে সন্দেহ করে উত্তেজিত জনতা দুজন নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করে। আরও কয়েকজন আহত হন। সে অঞ্চলের অধিকাংশ হিন্দুধর্মাবলম্বী হওয়াতে স্বাভাবিকভাবে ‘উত্তেজিত জনতা’ও (মব) ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্যদিকে, নিহত দুজনের ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান হওয়াতে এই ঘটনাতে ‘হিন্দু বনাম মুসলমান’ ডাইমেনশন তৈরি হয়। পাশের দেশ ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জোয়ারের স্মৃতি এবং ঘটনার নৃশংসতা সারাদেশে আলোড়ন তৈরি করে। প্রথম কয়েকদিন ঘটনার ভাসাভাসা বিবরণ এসেছিল।      

সম্প্রতি মানবজমিন ও আজকের পত্রিকা এই ঘটনার সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রথমদিকে যেভাবে ঢালাওভাবে ‘গণপিটুনি’র কথা বলা হয়েছে, বিস্তারিত প্রতিবেদনগুলোতে তার চেয়ে ভিন্ন বিষয়গুলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। গণপিটুনি হয়েছে সত্য, কিন্তু তার আগে আরও বেশকিছু ঘটনা রয়েছে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য অজিৎ কুমার সরকারের সাথে নির্মাণশ্রমিকদের ঈদের আগ থেকেই ঝামেলা চলছিল। চাঁদা দাবি করা হয়; না দিলে মারধরের হুমকি দেয়া হয়। নির্মাণকাজের রড নিতে গেলে আশরাফুল খান বাঁধা দেন। অজিতের লোকজন আশরাফুল খান সহ বাকি শ্রমিকদের হুমকি ধামকি দিয়ে চলে যান। এমনকি ঘটনার দিন (১৮ এপ্রিল) অজিত কুমার সরকারের নির্দেশে বিনয় সাহা নামে আরেকজন দলবল নিয়ে রড নিতে গেলে শ্রমিকদের সাথে ধস্তাধস্তি হয়। ওইদিন সন্ধ্যার পরেই ঘটনা ঘটে। উল্লেখ করা জরুরি, সেদিন যে শ্রমিক বাঁধা দিয়েছিলেন সেই আশরাফুল খান গণপিটুনিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যাচ্ছে, আগুন লাগার ঘটনার পর শ্রমিকরাও আগুন নেভানোর কাজ করছিলেন। এর মধ্যেই কয়েকজন তাদের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়তে থাকেন। তারপর সকল শ্রমিককে দড়ি দিয়ে বেধে রাখা হয়। এরপর অজিত কুমার সরকার আসেন। তিনি শ্রমিকদের একটা শ্রেণিকক্ষে ঢোকান। আরেক ওয়ার্ডের মেম্বার লিংকন বিশ্বাসও আসেন। অজিত কুমার ফোন দিয়ে চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান তপনকে আনেন। চেয়ারম্যান আসার পর মারধর শুরু হয়। ‘তোর কতো বড় সাহস, তুই মন্দিরে আগুন দিস, দাঙ্গা সৃষ্টি করিস’ বলে তিনি মারধর শুরু করেন।

আশরাফুলকে দিয়েই মারধর শুরু করেন। অজিত কুমারও মারধরে অংশ নেন। প্রতিবেদন থেকে বোঝা যাচ্ছে, চেয়ারম্যান পুরো ঘটনা জেনেছেন অজিতকুমারের কাছ থেকেই। যে অজিতকুমারের সাথে নিহত শ্রমিক আশরাফুল সহ বাকিদের আগ থেকেই গেঞ্জাম চলছিল। তারা মারধর শুরু করার পর উত্তেজিত জনতা, যারা ইট পাটকল মারছিল, তারা প্রবেশ করে মারধর শুরু করে।

আজকের পত্রিকা দুটো ভিডিওর কথা বলেছে। একটা ভিডিওতে দেখা গেছে, নির্মাণ শ্রমিকদের পিঠমোড়া করে বেঁধে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অজিত কুমার সরকারের সঙ্গে চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপনকে শ্রমিকদের জেরা করতে দেখা যায়। একপর্যায়ে তিনিও শ্রমিকদের মারধর করেন। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, শ্রেণিকক্ষ বন্ধ করে কয়েকজন তরুণ লাঠি ও লোহার রড দিয়ে বেধড়ক মারধর করছে শ্রমিকদের। হলুদ, খয়েরি ও নীল রঙের টি-শার্ট পরা তিন তরুণই বেশি নির্যাতন করেন। এ সময় চিৎকার করছিলেন শ্রমিকেরা। শ্রেণিকক্ষের বাইরে অবস্থানরত উত্তেজিত জনতা তাতে উৎসাহ দিচ্ছে। আজকের পত্রিকা তাদের অনুসন্ধান থেকে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছে যারা মারধরে অংশ নিয়েছেন।
পুলিশ এসেছে এরপরে। পুলিশ এসে উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে করতে দুইজন শ্রমিক মারা যান।

আপাতত এই দুটো প্রতিবেদন থেকে যা বোঝা যাচ্ছে, অজিতকুমার ও তার দলবলের সাথে শ্রমিকদের নির্মাণকাজ নিয়ে ঝামেলা পুরো ঘটনার পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে। যেহেতু, অত্র অঞ্চলের অধিকাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী, সেহেতু ভিকটিমদের ‘শ্রমিক’ ও ‘মুসলমান’ দুই পরিচয়ই তাদেরকে সহজেই উত্তেজিত জনতার কাছে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। শুরুতে আগুন নেভাতে শ্রমিকরা থাকলেও যে কয়জন তাদের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়েন, তাদের মধ্যে অজিতকুমারের লোকজনের উপস্থিত থাকাটা অনুমান করা একেবারেই অসম্ভব নয়। প্রতিবেদন থেকে মনে হয় পুরো ঘটনার হোতা অজিতকুমার। এইদিক থেকে দেখলে মানবজমিনের হেডলাইন (প্রথম মার শুরু করেন চেয়ারম্যানই যোগ দেন শত শত মানুষ) মিসলিডিং! সেখানে হোতা চেয়ারম্যানকেই মনে হচ্ছে।

প্রতিবেদন থেকে আরেকটা বিষয় অনুমান করা যাচ্ছে, পুরো পরিস্থিতিকে শান্ত করা চেয়ারম্যান ও অজিত কুমারের পক্ষে সম্ভব ছিল। তারা না আসা পর্যন্ত মারধর শুরু হয়নি হয়তো। শুরুতে এর ধরন ‘গণপিটুনি’ও ছিল না। একেবারে উপরের সারির (অর্থাৎ, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ঘনিষ্ঠজনই হওয়ার কথা) কয়েকজনই রড ও কাঠ দিয়ে মারধর করেন। অন্তত প্রতিবেদনগুলোতে সেরকমই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি পুলিশকেও ফোন দেওয়া হয়েছে পরে। এটাকে একেবারে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলেই মনে হচ্ছে, যেখানে উত্তেজিত জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা হয়েছে।

মন্দিরে আগুন লাগা থেকে শুরু করে গণপিটুনি - এমন ধরনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের মানুষের প্রচুর রয়েছে। এগুলোকে সাধারণত কেবল ধর্ম বা শ্রেণি বা রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্টতা দিয়ে বোঝা ও ব্যাখ্যা করার কোশেশ করা হয়। কিন্তু তাতে পুরো ঘটনা ধরে পড়ে না। বরঞ্চ, স্থানীয় ক্ষমতাশীল ব্যক্তিবর্গ, উত্তেজিত জনতার ‘হিন্দু’ পরিচয় এবং ভিকটিমদের ‘মুসলমান’ ও শ্রমিক পরিচয় - এইসবগুলো বর্গের মিথস্ক্রিয়াতেই ফরিদপুরের ঘটনাকে আমাদের বুঝতে পারা দরকার।

ফরিদপুরের ঘটনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। জনগণের মিছিলে পুলিশের গুলি চালানোর সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। দ্রুততার সাথে আইনি পদক্ষেপ না নেয়া গেলে, বিচার প্রক্রিয়া শুরু না করতে পারলে, এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। একদিকে যেমন নানাপ্রকারের সন্দেহের ডালপালা ছড়াতে থাকবে, তেমনি অঞ্চলের মুসলমান ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিক্ততার পরিবেশ তৈরি হতে থাকবে। প্রান্তিক হিন্দু জনগোষ্ঠীকে ঝুঁকির মধ্যেও ফেলে দেওয়া হবে। যদিও বাংলাদেশে কখনোই এই ধরনের সহিংসতার কোনো বিচার আমরা দেখিনি। বরঞ্চ ক্ষমতাবলয়ের এক ধরনের সায়-ই দেখা যায় এতে।

অনুসরণ করুন