‘ইন্ডিয়া আউট' শ্লোগান এবং ভারতের পণ্য বর্জন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এর ফলে বেশ মজার একটা দৃশ্যপট আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এই আন্দোলন ভারতকে কতটা বেকায়দায় ফেলবে বা ফেলেছে তার থেকে বড় কথা- বাংলাদেশে যারা ভারতের সহায়তায় ক্ষমতাবান তাদেরই এখন দায় পড়েছে ঋণ শোধ করার। বিষয়টি এমন- অনেক নুন খেয়েছেন এবার গুন গাইতে থাকুন। ঠেকান এই আন্দোলন। পরিস্থিতি এখন সে রকম মনে হচ্ছে। তবে এত দ্রুত ঋণ শোধের কাজটা শুরু হবে তা হয়তো তারা ভাবতে পারেনি। কারণ, বাংলাদেশে তাদের পোষ্যরা রাখঢাক না করেই খুব দ্রুত ভারতের পক্ষে দাঁড়ানো শুরু করেছে। যেন এ দেশের মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে তারা দেখিয়ে দিতে চায়, দেখো কারা খাঁটি ভারতপন্থী এবং কারা বাংলাদেশপন্থী।
আজ এক দিকে ভারতের অনুগতরা অন্যদিকে বাংলাদেশীরা। এত বছর পর এই একটি আন্দোলন একে একে প্রকাশ্যে তুলে আনছে সেই সব রাজনৈতিক দল ও তার নেতাদের- যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পাকিস্তানের দালাল, রাজাকার, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি বলে সমালোচনা করতো। এই একটি ঘটনায় তাদের মুখোশ পুরোপুরি খসে পড়েছে।
এরা ভারতের দালালীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে মিশিয়ে এমন একটা মতবাদ দাঁড় করিয়েছে যে, যারাই এর বিরোধিতা করবে তারাই রাজকার, তারাই পাকিস্তানপন্থী। ইতিমধ্যে একজন সাবেক মন্ত্রী ভারতীয় পণ্য বয়কট আন্দোলনকে পাকিস্তানের সঙ্গে রিলেট করে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছেন। অন্য মন্ত্রীরাও প্রায় একই সুরে কথা বলছেন। কিন্তু তথ্যপ্রবাহের এই আধুনিক যুগে যে দেশটি নিজেই অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে, সেখানে জেনেশুনে কেউ সেই দেশের দালালী করবে এটা কি কেউ বিশ্বাস করবে? বরং বর্তমানে পাকিস্তানে যা চলছে তার সঙ্গে এদেশের বর্তমান শাসকদের অনেক মিল আছে। সেই ক্ষেত্রে উভয় দেশের শাসকরা গলায় গলা মিলিয়ে বলতে পারে কর্তৃত্ববাদ জিন্দাবাদ।
এসব সত্ত্বেও যদি কেউ মনে করেন যে, কারো দালালী করা তাদের একচেটিয়া ব্যাপার তাহলে সেটা ভিন্ন কথা।
পৃথিবীর অনেক দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে এবং অন্য একটি দেশ সে যুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা করেছে। তাই বলে কেউ কারো অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির দখলদারিত্ব থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করতে সব কিছু করেছিল ব্রিটেন। এমন কি জেনারেল দ্য গল সেখানে আশ্রয় লাভ করেছিলেন। সে জন্য কি ফরাসিরা ব্রিটেনের প্রতি কখনো আনুগত্য প্রদর্শন করেছে? না, কখনো তারা তা করনি। বরং ফরাসি জাতি তার অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে আসছে সবসময়। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ফ্রান্স কখনোই ব্রিটেনকে ছাড় দেয়নি।
একইভাবে প্রায় তিন দশকের যুদ্ধে ভিয়েতনামকে চীন সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। তাই বলে ভিয়তনাম কখনো চীনের অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। বরং নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় ১৯৭৯ সালে চীনের বিরুদ্ধে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল ভিয়েতনাম। এরকম আরো অনেক উদাহারণ আছে। কিন্তু কেউ আমাদের মতো কেবলমাত্র ক্ষমতা নিশ্চিত করতে এতটা নতজানু হয়নি ।
তবে এ সত্য স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান ছিল। আমারা তা স্বীকার করি। কিন্তু ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশকে একটা নির্জীব জাতিতে পরিণত করার কোনো প্রচেষ্টা এ দেশের জনগণ সফল হতে দেবে না।