Logo
Logo
×

অভিমত

আওয়ামী বয়ান ও বলের শাসন

Icon

জুবায়ের কায়সার

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৫:০৭ পিএম

আওয়ামী বয়ান ও বলের শাসন

৩ মেয়াদে টানা ১৫ বছরের আওয়ামী শাসন বাংলাদেশের ইতিহাসের  দীর্ঘতম শাসনকাল। প্রায় কোন প্রকার বড়সড়ো প্রতিরোধ বা বাধার মুখোমুখি না হয়েই  আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন আছে। অপরিসীম বলপ্রয়োগ  ও ভীতি তৈরি এই নির্বিঘ্ন অবস্থানের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলেও আরো কিছু কারণ আলোচনায় আনা প্রয়োজন। তবে, আজ আলোচনা করবো একনায়কী শাসনে মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, অর্থাৎ কীভাবে বলপ্রয়োগ , সম্মতি ও বয়ান তৈরির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টিকে আছে এবং  এ ক্ষেত্রে মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীকুল কেন ও  কীভাবে এই রেজিমকে সহায়তা করছে।

শুধু আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছাড়া প্রায় অন্য সমস্ত ধারাকে বলপ্রয়োগ দ্বারা পর্যুদস্ত করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে তারা সহযোগী হিসেবে পেয়েছে মিডিয়া এস্টাব্লিশমেন্টকে, ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের খবর প্রায় সমস্ত মিডিয়া চেপে গেছে৷ প্রায় কোন মিডিয়াই  টু শব্দ করেনি, না প্রিন্ট মিডিয়া, না ইলেকট্রনিক মিডিয়া। অথচ, দেশের প্রায় প্রতিটি নাগরিকের কাছে ভোট-চুরির এই ঘটনা দিবালোকের মত স্পষ্ট। সত্য প্রকাশ করলে অথবা সরকার- বিরোধীদেরকে পর্যাপ্ত স্পেস দিলে পত্রিকার নিবন্ধন বাতিলের ভয়, টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাবার আশংকা, সাথে জেল-জুলুমের ভয় কাজ করেছে, ও এখনো করছে। এটা গেলো আওয়ামী শাসনের রিপ্রেসিভ দিক।

আরেক দিক হচ্ছে, গভার্নমেন্টালিটি বা শাসনগিরির দিক৷ যেমন, সাংবাদিকদের জন্যে প্লট বরাদ্দ ও বিশেষ প্রণোদনা প্রদান, এবং সম্পাদক ও মালিকপক্ষকে নানা সুবিধা দান, বিদেশ ভ্রমনের সুযোগ ইত্যাদি।  মিডিয়ার স্বেচ্ছা- সেনসরশীপের পেছনে এসব  ভূমিকা রেখেছে। স্বেচ্ছা ও আরোপিত সমস্ত নিয়ন্ত্রণকে মেনে নিয়ে মিডিয়া সাব-অপ্রেসর বা  নির্যাতনে শাসকের সহযোগী থেকেছে।  দু'একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে মিডিয়া শান্তিপূর্ণ ও সূষ্ঠু নির্বাচনের আবহ তৈরি করে সরকারকে টিকে যেতে সহায়তা করেছে । বড় বড় সাংবাদিকরা  আওয়ামী লীগের নেতার মতোই দলকে সার্ভ করেছে। নানা রকম লজিকাল ফ্যালাসি ও টুইস্টেড আর্গুমেন্ট দিয়ে  সরকারের প্রায় সমস্ত অন্যয্য কাজকে তারা ন্যায্যতা দেবার আপ্রাণ ও ক্রমাগত চেষ্টা করেছে। মুখ-চেনা এই সাংবাদিকগণ নিরপেক্ষতার ভান করে আওয়ামী লীগের দলীয় বুদ্ধিজীবীদের মতো আচরণ করে সরকারের পক্ষে হেজেমনি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। সাংবাদিকদের বিরাট এক দল এই কাজে উদ্যোগী ও উদ্যমী ছিলেন এবং আছেন।   মিডিয়াকে যেভাবে আওয়ামী সরকার ব্যবহার করেছে,এবং  সাংবাদিকরা যে দলীয় আনুগত্যের পরিচয় দিয়েছে, বাংলাদেশে এর অন্য কোন নজির আছে কিনা সন্দেহ।  এই আমলে পরাধীনতাকেই তারা স্বাধীনতা মনে করে৷ বিএনপির আমলে তারা তাদের সমস্ত স্বাধীন সাংবাদিকতার পরাকাষ্ঠা দেখায়, আর আওয়ামী আমলে নতজানু আনুগত্য প্রকাশ করাকেই নিজেদের স্বাধীনতা ভাবে৷ "আল্লাহর মাল আল্লাহয় নিছে" বলাতে তৎকালীন মন্ত্রী আলতাফ হোসেন সাংবাদিকদের যে পরিমাণ প্রশ্নবাণের মুখোমুখি হয়েছিলেন,বর্তমান কোন মন্ত্রীর কোন কথার প্রতিক্রিয়া তার শতভাগের  একভাগও হবে না।  এভাবে, হলুদ ও হায়েনা সাংবাদিকতা এই অপশাসনের শক্তিশালী সহযোগী।

ইতিহাস, বিশ্বরাজনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কিছু সুবিধা পেয়েছে আওয়ামী লীগ ৷ মুক্তিযুদ্ধের নিজস্ব এক বিবরণী তৈরি করে আওয়ামী লীগ সেটিকে তার টিকে  থাকার হাতিয়ার বানিয়েছে ৷ বয়ান তৈরি ও তাকে সংহত করে একধরনের আবেগ ও ভক্তিভিত্তিক   রাজনীতি করছে এই দল। নিজের মতাদর্শকে একদম আবেগের পর্যায়ে ক্রিয়াশীল করে শাসনের ন্যায্যতা দেওয়া ও "অপর" তৈরির করার ফ্যাসিবাদী কায়দাকানুন দলটি ব্যবহার করছে।  গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন অধিক প্রয়োজন, এই বুলি তারা চাউর করেছে নীরবে বা সরবে৷ তথাকথিত উন্নয়নের প্রদর্শনী করে তারা তাদের লেজিটেমেসি তৈরির উদ্যোগ নেয়। মেট্রোরেল, পদ্মা ব্রিজ ইত্যাদি মেগাপ্রজেক্ট-এ প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি খরচ করে তারা একধরনের পারফরমেন্স লেজিটিমেসির বয়ান  জনগণের সামনে হাজির করে ; যা তাদের রুটিন ওয়ার্ক সেটাকে তারা তাদের এক্সট্রাঅর্ডিনারি সার্ভিস হিসেবে উপস্থাপন করে। অথচ, প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের প্রায় অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ও ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাওয়ার ঘটনাসমূহকে ঘটনা হিসেবে তুচ্ছ করা হয়  এবং  সেগুলো ক্রমাগত জনগণের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখার বন্দোবস্ত করা হয় , তথাকথিত উন্নয়নের মুলো ঝুলিয়ে। অথচ, সমস্ত মেগাপ্রজেক্টের বেনিফিসিয়ারি প্রথমত দুর্নীতিবাজ প্রশাসন ও দ্বিতীয়ত, কতিপয় উচ্চবিত্ত৷ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনমানের কোন উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন দীর্ঘ পনের বছরে হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, তারা যে কোনভাবেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার নয়, এই ব্যাপারটি নানা উদ্যোগ-আয়োজনের মধ্য দিয়ে তারা জনগণকে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে৷ বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো আওয়ামী স্বৈরশাসনকে অভিভাষিত করবার জন্যে শক্তিশালী ভাষাও তৈরি করতে পারেনি। অংশত, দাসানুদাস মিডিয়ার কারণে, এবং অংশত, সোশাল মিডিয়াকে দক্ষতার সাথে পরিকল্পিত ব্যবহারের অভাবের কারণেও। "স্বৈরাচারী সরকার", " অবৈধ সরকার", " ফ্যাসিবাদী সরকার", "একনায়কতান্ত্রিক সরকার", " ভোট চোর সরকার"  ইত্যাদি লবজ ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন সরকারের চিহ্নায়ন ঘটানোর যে জরুরি কাজ ছিল ও এখনো আছে, তা ঘটানো যায়নি। স্বৈরাচার সরকার বলতে এখনো এরশাদকেই বোঝানো হয় , অথচ এরশাদের শাসনামলের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতাকে এ সরকার অনেক আগেই ছাড়িয়ে গিয়েছে। এমনকি, নব্বইয়ের "গণ-অভ্যুত্থান"-কেও ক্ষমতাসীনেরা অর্থহীন করে দিয়েছে, কেননা, ইতিহাসে "গণঅভুত্থান"-এ উৎখাত হওয়া কোন শাসকের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হবার নজির নাই বললেই চলে। অথচ, এরশাদ ও তার দল বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সক্রিয় সহযোগী ও অংশীদার।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একমাত্র ন্যায্য ধারক ও মুক্তিদ্ধের পক্ষের একমাত্র শক্তি হিসেবে সে নিজেকে প্রচার করেছে, অব্যাহতভাবে। মুক্তিযুদ্ধের অর্ধশতবর্ষ অতিক্রান্ত হবার পরও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও বিপক্ষ শক্তি নামে এক বিভক্তি  তৈরি করে ক্রমাগত সে বিরোধী নিধনে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের নিজেদের  জল-অচল বয়ানে সামান্য কেউ টোকা দিলেই তাকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি থেকে বিরোধী শিবিরে নিক্ষেপ করা হয় ৷ একদা কাদের সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছিল; একে খন্দকারের ক্ষেত্রেও ঘটেছে।  শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকেও তারা তাদের বয়ানে আটাতে পারেন না, ইতিহাসে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে মুছে ফেলতে হেন কোন তৎপরতা নাই যা তারা বাকী রেখেছে।  মুক্তিযুদ্ধের একচেটিয়া কারবারি থেকে নিরবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক  ফায়দা লোটে তাঁরা । এ ক্ষেত্রে তাদের সহযোগী হিসেবে সাংবাদিক ছাড়াও কাজ করে বুদ্ধিজীবীরা। এই বুদ্ধিজীবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা অবসরপ্রাপ্ত আমলা। বাংলাদেশে  প্রগতিশীলতার বয়ানের ভেতরে ধর্মবিরোধিতা,বিশেষত, ইসলাম বিরোধিতা,  এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ; মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে মুসলিম জাতীয়তাবাদ বলে প্রচার করে "বাঙালি জাতীয়তাবাদ"-এর বড়ি গিলিয়ে একই সাথে ভারতপ্রেমী ও প্রগতিশীল শক্তি হিসেবে নিজেদের তারা প্রজেক্ট করেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক-বাহক হিসেবে আওয়ামী লীগকে এই বুদ্ধিজীবীরা সমর্থন দেন, ও তাদের শাসনামলে তাঁরা অধিকতর বুদ্ধিবৃত্তিক নিরাপত্তা বোধ করা শুরু করে । ৯/১১ এর পর আমেরিকার ওয়ার অন টেররের  প্রচারণাও বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের রশদ জুগিয়েছিল। "বাঙালিত্ব" ও " মুক্তিযুদ্ধের চেতনা"-কে তারা এমন তুরীয় পর্যায়ে নিয়ে যান  যে তা আলাদা "ধর্ম"-এ পরিণত হয় এবং বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমানকে তারা উন্নীত করেন প্রায় প্রত্যাদিষ্ট পুরুষের মর্যাদায়, যার সামান্য  অমর্যাদা ধর্ম-অবমাননা বা ধর্মাবতার-অবমাননার সমতুল্য হয়। এভাবে, ভক্তি ও আবেগের ফ্যাসিবাদী ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সমস্ত অন্যায্যতাকে তারা ন্যায্যতার বাতাবরণ পরিয়ে দেয়। দরবারি বুদ্ধিজীবীদেরকে মাঝে মাঝে সরকারের বিরুদ্ধে যে  দু'একটা কথা বলতে দেখা যায়,  তা আপনজনকে  স্নেহমূলকভাবে বকে দেবার অধিক কিছু নয়। বিএনপি দীর্ঘদিন থেকে জামাত থেকে দূরে থাকলেও পরিকল্পিতভাবে মিডিয়া ও দরবারি বুদ্ধিজীবীরা বিএনপি-কে জামাতের সাথে হাইফেনেটেড করেই প্রচার করেছে।

বল প্রয়োগ বা Coercion এর যে দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করেছে, নিকট অতীতে তার সমান্তরাল কোন উদাহরণ পাওয়া যাবে না। বিরোধীদলকে রাজপথে কোন প্রকার স্পেস না-দেবার অঘোষিত  নীতি তারা গ্রহণ করেছিল প্রায় এক দশক। স্রেফ কোন প্রকার স্পেস না দেওয়াই নীতি ছিল। স্পেস না দেবার এই  সরকারি নীতি প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও মেনে চলেছে।  দীর্ঘদিন টিভি টকশোতে বিএনপির পক্ষে জোড়ালো কোন কণ্ঠস্বর পাওয়া যায়নি, উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দকে মামলা দিয়ে হয় জেলে ভরে রাখা হয়েছে,নাহয় পালিয়ে থাকতে ও মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতের  কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে বলের শাসনকে প্রায় সফলভাবে কায়েম রাখতে পেরেছে। বিরোধীদল ও মতকে "অগ্নিসন্ত্রাসী" " মুক্তযুদ্ধবিরোধী", ইত্যাদি তকমা দিয়ে পরিপূর্ণভাবে উৎখাতের জায়নবাদী প্রবণতা তারা প্রদর্শন করেছে। অথচ, ট্র্বেনের বগি পুড়িয়ে দেওয়া, বাসে অগ্নিসংযোগের  প্রায় প্রতিটি ঘটনায় সরকারি দলের মদদ ও সংযোগ স্পষ্ট। ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গণতন্ত্র হত্যা করে, দেশের রাজনীতিকে নির্মূল করে  মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি চেতনাকে ধবংস করেও এরা  মুক্তিযুদ্ধের বিরাট সপক্ষ শক্তি! 

সংবিধান এদের কাছে একখানি ছিন্নপত্রের অধিক কিছু নয় ; ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে যেকোনো আইন তারা পাশ করতে সক্ষম, এবং প্রয়োজন মতো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ ও তার স্বার্থান্বেষী ব্যবহারে তারা ইতোমধ্যেই পারঙ্গমতা অর্জন করেছে।  সংবিধান যেখানে জনগণের "সার্বভৌমত্ব" স্বীকার করে নিয়েছে, সেখানে তারা তাদের নিজেদের ইচ্ছা ও আদেশমতো পরিবর্তিত সংবিধানকে সার্বভৌম বলে প্রচার  করে।  সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে তারা একনায়কী শাসন প্রতিষ্ঠাই তাদের লক্ষ্য। তানাহলে, অর্থবহ নির্বাচনে তাদের উদ্যোগী হতে দেখা যেতো। বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন নির্বাচন কোন নির্বাচন নয়, এটা এক রাজনৈতিক ম্যানেজমেন্ট। এটা এমন এক ব্যবস্থাপনা যেখানে আওয়ামী লীগের হেরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই এই নির্বাচন ২০১৪ ও ২০১৮ থেকে ভিন্ন কিছু নয়। ২০১৪ সালে বিএনপি-বিহীন নির্বাচনে অটো-বিজয় হয়েছে, এবং ও ২০১৮ সালে নজিরবিহীন রাতের ভোটের মাধ্যমে সে আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারিতেও একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, কোন দৈব ঘটনা না ঘটলে।

১৫ বছর ব্যাপী শাসন বাংলাদেশে সম্পূর্ণ এক নতুন পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা আগে কখনো ঘটেনি৷ পুলিশ ও আইনশৃঙ্গলা বাহিনীকে   কখনো ছররা গুলি ছুড়তে দেখা যায়নি। ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পুলিশ এগুলো ব্যবহার করতো বিরোধী দলের মিটিং-মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করতে। সভা করতে দেওয়া হয়নি প্রায় এক যুগ। আমেরিকার ভিসা নীতি ঘোষিত হবার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে কিছু সভা-সমাবেশ করা গেছে। আওয়ামী শাসনের বলপ্রয়োগের আরেকটি রকমফের হলো, ম্যাসাকার। ২০১৩ সালে শাপলা চত্তরে ম্যাসাকারের মধ্য দিয়ে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, কোন তীব্র বিরোধী মতকে দাঁড়াতে দেওয়া হবেনা। এমন ভয় এই শাসন ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, হেফাজত আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বললেই চলে। মোদির আগমন বিরোধী আন্দোলনেও বেশ কয়েকজনকে পুলিশ হত্যা করেছে৷ শাসকের অনুগত মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীরা  পুলিশি বর্বরতাকে লুকিয়ে সবসময় মজলুমের উপর দোষ চাপাতে ব্যস্ত থাকায় পুলিশ ও সরকার প্রতিটি ঘটনায় দায়মুক্ত থাকার শর্ত তৈরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আর্মি ও প্রশাসনের সর্বস্তরে নেতৃত্বের পর্যায়ে আওয়ামী শাসনকে চিরস্থায়ী করতে প্রতিশ্রুতদের পদায়িত করা হয়েছে। ফলে, এক দানবীয় শাসক ও শাসন ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে।

এর পতনের জন্যে আয়োজনকেও প্রায় সমান বৃহৎ হতে হবে। প্রতিরোধী বয়ান তৈরি, বিদ্যমান  শাসকশ্রেণীকে সম্বোধন করবার জন্যে শক্তিশালী ভাষা তৈরি,  শক্তিশালী বিকল্প মিডিয়া তৈরি, থিংক ট্যাংক গঠন, নতুন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক প্রচারব্যবস্থা প্রস্তুতকরণ,আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বহাল শাসকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন,গুম ও হত্যার প্রসঙ্গ তুলে ধরাসহ বৃহত্তর গণআন্দোলনই পারে এই গনবিরোধী সরকারের পতন ঘটাতে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, জনগণের ভোটের উপর নির্ভর না করে পুলিশ ও প্রশাসনের উপর নির্ভর করায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও অপাংক্তেয় হয়ে উঠেছে। পূর্বে যারা জাতীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্যে সম্মানিত ছিল, তাঁরাও অনির্বাচিত এই সরকারের সহযোগী হওয়ায় নিজের পূর্বের অবদানকে কালিমালিপ্ত করেছেন৷ তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেননসহ আরও অনেককে এই তালিকায় ফেলা যাবে। স্বৈরতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে সম্মানিত মানুষজন এ ব্যবস্থায় লাঞ্ছিত হয়। অনির্বাচিত সরকারের সদস্যদের কী পরিণতি হয়, তা-র নজির হচ্ছে : একজন প্রতিমন্ত্রীও এখন ওসিকে বদলি করতে ব্যর্থ হয় ; শাসকদলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহকে এসপির বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে হয়, এমপি'রা  অনির্বাচিত হওয়াতে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ প্রধানের সামনে নতজানু হয়ে চলতে হয়। কারণ, তারা জানে তাদের ক্ষমতার উৎস জনগণের ভোট নয়। পুরো শাসনব্যবস্থার এই যে আমলাতন্ত্রায়ন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর এই যে অস্বাভাবিক নির্ভরশীলতা, এগুলো  রাজনীতিবিদদেরকে  লাঞ্ছিত ও ক্ষমতাহীন করে দেবার পাশাপাশি, শাসকদল ও শাসনব্যবস্থার জন্যেও  বুমেরাং হয় । নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যার একমাত্র সমাধান। তানাহলে, জনগণের জন্যে অপেক্ষা করছে সীমাহীন জুলুম, লাঞ্ছনা ও ভোগান্তি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন আওয়ামী লীগের "দলীয় কাউন্সিল নির্বাচন"-এর অধিক নয়। কেউ কেউ একে বলছেন সার্কাস, কেউ বলছেন প্রীতি ফুটবল ম্যাচ। আবার,  এই ক্ষমতাসীনদের হাত দিয়ে তৈরি হচ্ছে "গণতন্ত্র", "উন্নয়ন" ও "মতপ্রকাশের স্বাধীনতা"র নতুন সব  আওয়ামী সংজ্ঞা । "মতপ্রকাশের স্বাধীনতা" হচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ ক'রে দলটির প্রতি সুধারণা রেখে দলটিকে ক্ষমতায় আসীন রাখার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় স্নেহমূলক ভিন্নমতের প্রকাশ। আর, "গণতন্ত্র " হচ্ছে আওয়ামী সমর্থকদের দ্বারা আওয়ামী প্রার্থীদেরকে ভোট বা ভোটবিহীনভাবে প্রতিনিধি হিসেবে  নির্বাচিত করা। আওয়ামী লীগের দ্বারা, আওয়ামী লীগের জন্যে ও আওয়ামী লীগের সরকারকেই গণতন্ত্র বলে। আর, "উন্নয়ন" মানে হচ্ছে, আওয়ামী ব্যবসায়ীদের, দলীয় সদস্য ও অনুগতদের  দেশ-বিদেশে ব্যবসাবাণিজ্য  ফুলে-ফেঁপে ওঠা, ও ব্যাংক-হিসাব স্ফীত থেকে স্ফীততর হওয়া। আর, "জনগণ" বলতে বোঝায়   আওয়ামী সমর্থক ও নেতাকর্মীদের বশ্য অবয়ব বা ডোসাইল বডি'কে; আর,  বলাই বাহুল্য,  বঙ্গবন্ধুই এক টুকরো বাংলাদেশ। এ  ছাড়া স্বাধীনতা, উন্নয়ন, দেশ ও গণতন্ত্র-এর আর কোন অর্থ নেই এদের কাছে। পরাশক্তির বিরুদ্ধে "উন্নত শির " হয়ে থাকা মানে হচ্ছে, ভারতের সহায়তায় ক্ষমতায় টিকে থাকা, ও নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার  প্রয়োজনে আমেরিকান নীতির  বিরোধীতা, ও ক্ষমতায় স্থিত থাকারই  প্রয়োজনে আমেরিকান দূতাবাসে ধরনা দেওয়া। আওয়ামী স্বার্থই জাতীয় স্বার্থ। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা মানেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষিত হওয়া।  বলপ্রয়োগের নজিরবিহীন ধরণ ও বয়ান তৈরির  এই নিরতিশয় আওয়ামীকরণের মধ্য দিয়ে এই ফ্যাসিস্ট সরকার নিজেদের ক্ষমতাকে সংহত করতে প্রতি মূহুর্তে সজাগ। 

জুবায়ের কায়সার: লেখক ও কলামিস্ট 

 

অনুসরণ করুন