Logo
Logo
×

সংবাদ

বঙ্গবন্ধু স‌্যা‌টেলাইট : আয়ু ফুরি‌য়ে যা‌বে, খরচ উঠ‌বে না, থে‌কে যা‌বে ঋণ!

Icon

ঢাকা অফিস

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৪০ পিএম

বঙ্গবন্ধু স‌্যা‌টেলাইট : আয়ু ফুরি‌য়ে যা‌বে, খরচ উঠ‌বে না, থে‌কে যা‌বে ঋণ!

পুরোনো ছবি

উৎক্ষেপণের দিন (২০১৮ সালের ১২ মে) থেকে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত আয়ের মুখ দেখেনি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। যদিও এরপর থেকে স্যাটেলাইটটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের দেখানো এই লাভজনক ধরে নিয়েও যদি হিসাব করা হয়, তবে স্যাটেলাইটটি থেকে এই ‘লাভ’ আসবে আর মাত্র ১১ বছর। কারণ স্যাটেলাইটটির সক্ষমতা থাকবে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত।

কর্মক্ষম সময়ে সরকারি হিসাবে মাসে ৯ কোটি টাকা নিট আয়ে বছরে আসবে ১০৮ কোটি টাকা। মেয়াদ শেষে এই আয় দাঁড়াবে ১ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। যদিও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের এই পুরো প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে ১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা ঋণ এসেছে চীন প্রভাবিত এইচএসবিসি ব্যাংক থেকে।

স্যাটেলাইতের আয়ুষ্ককাল শেষে বাংলাদেশের ক্ষতি দাঁড়াবে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশের কাছে স্যাটেলাইট সিস্টেম বিক্রি করে ১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা নিয়েছে ফ্রান্স। হাজার কোটি টাকার ঋণে ব্যবসা করেছে চীনা এইচএসবিসি ব্যাংক। আর বাংলাদেশ পড়েছে ১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকার ঋণের ফাঁদে।

আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, প্রথম স্যাটেলাইটে ব্যয়ের ৫০ শতাংশ টাকা ওঠা নিয়ে সংশয়ের মধ্যেই দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য রাশিয়ার কাছে ইতোমধ্যে ঋণের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। বলা যায়, দেশের মানুষকে আরও একটি ঋণের চক্রে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে হাসিনা সরকার।  

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সিস্টেমের নকশা তৈরির জন্য ২০১২ সালের মার্চে প্রকল্পের মূল পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল’। এরপর ১ হাজার ৯৫১ কোটি ৭৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকার চুক্তিতে ফ্রান্সের কোম্পানি তালিস এলিনিয়া স্পেস থেকে কেনা হয স্যাটেলাইট সিস্টেম। সব মিলিয়ে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে উৎক্ষেপণ হয় স্যাটেলাইটটি।

বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ মোট ৩৮টি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল এবং ডিটিএইচ (ডোর টু হাউজ) অপারেটর ‘আকাশ’ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে সম্প্রচার করছে। 
স্যাটেলাইট কোম্পানির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২২-২৩) অনুযায়ী, প্রতি মাসে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১০ কোটি টাকা আয় করে। এই আয়ের এক-দশমাংশ হয় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়।

মহাকাশে যাত্রার এক বছর পরে ২০১৯ সালের ১৯ মে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে স্যাটেলাইটটি। সরকারি হিসাবে পরিচালন ব্যয় বাদে প্রতি মাসে নিট আয় ৯ কোটি টাকা। উৎক্ষেপণের প্রথম তিন বছরে (২০২২ পর্যন্ত) স্যাটেলাইটটি থেকে কোনো আয় করতে পারেনি বাংলাদেশ।

বর্তমানে স্যাটেলাইটটির সি ব্যান্ডের ১৪টি ট্রান্সপন্ডারের সবগুলোই বিক্রির জন্য চুক্তি হয়েছে। আর কেইউ ব্যান্ডের ট্রান্সপন্ডারের সক্ষমতার প্রায় ৩৪ শতাংশ বিক্রি হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট ৪টি সরকারি ও ৩টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভিস্যাট সেবা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

এদিকে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ থেকে আর্থিক দুর্গতির মধ্যেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে পিডবি¬উসি। প্রকল্প বাস্তবায়নে ইআরডি গত বছরের ৩ এপ্রিল রাশিয়ায় ঋণের চাহিদার বিষয়টি উল্লেখ করে পত্র দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি (বিএসসিএল) বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুতের কার্যক্রম শুরু করেছে। চূড়ান্ত ডিপিপি তৈরি ও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে সরকারের পরবর্তী নির্দেশনা মোতাবেক স্যাটেলাইট নির্মাণ ও উৎক্ষেপণের পরবর্তী উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

অন্যদিকে, নিজের স্যাটেলাইটে লাভের মুখ না দেখলেও, ভারতের উদ্যোগে ‘সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইট’ উৎক্ষেপণে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে ২০১৭ সালের ২০ মার্চ একটি প্রস্তাব অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। ওই চুক্তির ফলে বিনামূল্যে বিভিন্ন স্যাটেলাইট বেজ সার্ভিসের জন্য প্রস্তাবিত সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইটের ‘ক্যাপাসিটি’ ব্যবহার করা যাবে। এই স্যাটেলাইটে ১২টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে; যার একটি বাংলাদেশকে বিনামূল্যে দেওয়ার কথা বলেছে ভারত।

কেন এমন প‌রি‌স্থি‌তি তৈরি হলো

বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানিতে (বিএসসিএল) প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনে (বিটিআরসি) কর্মরত একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা আউটলুককে বলেন, এ পর্যন্ত পৃথিবীর যে কোনো দেশ যখন তাদের স্যাটেলাইট উড়িয়েছে; প্রত্যেকেই তাদের স্যাটেলাইটকে নিজের অক্ষরেখায় উড়িয়েছে। অক্ষরেখায় বাংলাদেশ অবস্থান করছে ৮৬.৯১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। এই হিসাব বিবেচনা করলে বাংলাদেশ ৮৬.৯১ ডিগ্রিতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের স্লট পাওয়ার কথা। কিন্তু ৮৮.৯১ ডিগ্রি পজিশনে রাশিয়ার দুটি সহ আরও চারটি স্যাটেলাইট রয়েছে। তাই এই পজিশনে স্থান পাওয়া সম্ভব হয়নি। 

তিনি জানান, ৮৬.৮৮ ডিগ্রি স্লট সম্পূর্ণ ফাকা থাকার পরও মহাকাশ সংস্থা আইটিইউ বাংলাদেশকে কোনো প্রকার স্লট দেয়নি। কেন দেয়নি কিংবা অথোরিটি কেন সেখানে স্লট পায়নি, সে প্রশ্নের উত্তর আমরা আজ পর্যন্ত পাইনি।
এরপর বাংলাদেশ ১০২ ডিগ্রিতে স্থান পাওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু এই স্লটেও রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশ বঙ্গবন্ধু স্যটেলাইট স্থাপনে আপত্তি জানায়। কারণ হিসেবে ওই সব দেশ জানায়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট তাদের সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটাবে। এরপর বাংলাদেশ চেষ্টা করে ৭৯ ডিগ্রিতে স্থান পেতে। চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ এখানেও বাঁধা দেয়—যোগ করেন তিনি। 
 
ওই প্রকৌশলী জানান, ৪০টি দেশের মধ্যে বেশিরভাগ দেশই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপনে বাংলাদেশকে বাঁধা দেয়। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু স্যটেলাইট স্থান পায় ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমা রেখায়। 

এখনেই মূল সংকট উল্লেখ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই তরঙ্গ প্রকৌশলী আরও বলেন,  প্রশ্ন হলো ৯০ ডিগ্রিতে থাকা বাংলাদেশকে ১১৯.১ ডিগ্রি দ্রাঘিমা রেখায় থাকা স্যাটেলাইট কতটুকু কাভার করতে সক্ষম হবে?  যেকোনো স্লটে স্যাটেলাইট স্থাপন করলেই যদি নিখুঁতভাবে কাভার করা সম্ভব হতো তাহলে অন্যান্য দেশগুলো তাদের নিজের অক্ষরেখায় স্যাটেলাইট কেন উড়ায়? কিংবা যদি কোনো সমস্যা না হয় তাহলে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই এতো আপওি জানালো কেন? আইটিইউ কেন বাংলাদেশকে ৮৬.৮৮ ডিগ্রিতে স্লট দিলো না? এসব প্রশ্নের উত্তর যাই হোক না কেন; এগুলো নিশ্চয়ই বাংলাদেশের পক্ষে যাবে না।

বিএসসিএলের নির্ভরশীল এবং দায়িত্বশীল অপর এক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট জিওস্টেশনারি অর্থ্যাৎ ভূপৃষ্ঠ থেকে এটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় স্থির থাকবে মেয়াদকাল পর্যন্ত। কিন্তু পৃথিবীকে প্রদক্ষিণকালেও কোনো অরবিটে ঘুরবে না।  

বিএসসিএলে কর্মরত ওই প্রকৌশলী বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল বা বেসরকারি কোম্পানিগুলো কি বলা মাত্রই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে সেবা গ্রহণ করেছে? আমাদের স্যাটেলাইটের সেবার মান বিদেশি স্যাটেলাইট থেকে যে উন্নত হবে তার নিশ্চয়তা বা ঘোষণাও আমরা দিতে পারিনি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিদেশে সেবা দিয়ে ৫০ মিলিয়ন ডলারের আয়ের স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের সেবা কিনবে কারা? ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, আরব কিংবা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কোনো দেশ? বাংলাদেশ তো এখনও সম্পূর্ণরূপে ভারতের ওপর নির্ভরশীল। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে নেপাল, ভুটান কিংবা অন্য কোনো দেশ ভারত বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে সেবা কেন নেবে। ভারতও এ বাণিজ্যে বাংলাদেশকে ভাগ দেবে না কখনোই।  

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের এক প্রকৌশলী বলেন, বিভিন্ন প্রকার স্যাটেলাইট বিভিন্ন রকমের কাজে ব্যবহার করা হয়। মাত্র কয়েকটি দেশ বাদে প্রায় সব দেশেরই একাধিক স্যাটেলাইট রয়েছে। কিন্তু আমরা দাবি করছি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দিয়ে সব রকমের কাজ করা সম্ভব হবে। এটা অবাস্তব। ভারতের ৬৭টি স্যাটেলাইটের মধ্যে ৩৪টি স্যাটেলাইটই মূলত টেলিকমিউনিকেশনের জন্য ব্যবহার করা হয়। আর বাকিগুলো আবহাওয়া এবং কমিউনিকেশনের কাজে ব্যবহার করে। এখন প্রশ্ন হলো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের এতো নিম্ন ক্ষমতা দিয়ে কিভাবে সব ধরনের সার্ভিস পাওয়া যাবে? 

তিনি বলেন, সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে আকাশে উৎক্ষেপণ করা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ৪২ শতাংশ নিজস্ব কক্ষপথে যেতেই ব্যর্থ হয়েছে। কক্ষপথে গিয়ে সঠিক ভাবে কাজ করেছে মাত্র ১৫ শতাংশ। এই ১৫ শতাংশ কি সব রকমের সেবা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট? 

স্যাটেলাইটটির বিপণন বিভাগ সূত্র বলছে, এটা আগেই অনুমেয় ছিল যে বাংলাদেশের আশপাশের মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভুটানসহ কয়েকটি দেশ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সেবা নিতে পারে। কিন্তু এত ব্যয়বহুল স্যাটেলাইট কেউই ভাড়া নিতে রাজি হয়নি এখনো পর্যন্ত। 

ওই সূত্রটি আরও জানায়, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত নিজেই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও নির্মাণে সক্ষম। ইতোমধ্যে তাদের একাধিক স্যাটেলাইট মহাকাশেও রয়েছে। বাংলাদেশের সম্ভাব্য ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী হবে ভারত। বাংলাদেশ কি পারবে ভারতের থেকে কম দামে নিজের ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দিতে। আর চীনের কথাতো বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের কাছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট অনেকটা সাদা হাতি পালার মতো। কেবলমাত্র দেশের কয়েকটি টিভি চ্যানেল দিয়ে এত ব্যয়বহুল একটি স্যাটেলাইটের খরচ পুষিয়ে লাভ করা অসম্ভব বলে জানান ওই বিপণন কর্মকর্তা। 

এছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ টেলিকম সেবা, ওয়েদার ফোরকাস্ট, মিলিটারি কমিউনিকেশন, শিক্ষা ক্ষেত্রে বা অন্যান্য যেসব সেবা সহজ হওয়ার কথা বলা হয়েছিল, সেগুলোর কোনোটিই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর কাজ নয় বলেও পরিষ্কার করেন ওই কর্মকর্তা। এসব বিষয় নিয়ে বিএসসিএল কাজ করছেও না বলে জানান তিনি। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. শাহ্জাহান মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি বাংলা আউটলুককের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। 

অনুসরণ করুন