Logo
Logo
×

সাক্ষাৎকার

‘১৬ দিন পর আমাদের ৩ জনকে চোখ-হাত বেঁধে রাস্তায় ফেলে দেয়, বাকি দুই সহকর্মীর আর কোনো খবর পাইনি’

Icon

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২৪, ০৬:৩৪ পিএম



‘১৬ দিন পর আমাদের ৩ জনকে চোখ-হাত বেঁধে রাস্তায় ফেলে দেয়, বাকি দুই সহকর্মীর আর কোনো খবর পাইনি’

বকশিবাজার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এক সহকর্মীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর দুপুর দেড়টার দিকে হঠাৎ আমাদেরকে চার-পাঁচ জন লোক ঘিরে ফেলে। প্রধান সড়কে দাঁড়ানো একটি কালো রংয়ের হাইএস গাড়িতে বিপ্লব, সোহেল, সম্রাট, মিঠু এবং আমাকে জোর করে তুলে নেয়। ঘণ্টাখানেক গাড়ি চলার পর একটি নির্জন স্থানে আমাদের নামায়। গাড়িতে আমাদেরকে বেদম পেটায়। সেই নির্জন স্থানেই পৃথক চেম্বারে আমাদের হাত, চোখ বেঁধে ফেলে রাখে। টানা ১৬ দিন নির্মম নির্যাতন চালায়। শেষ দিন বিপ্লব, মিঠু এবং আমাকে হাত, চোখ বেঁধে বাইরে নিয়ে আসে। ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশে গাড়ি থামিয়ে ফেলে দিয়ে যায়। বাকি দু’জন সোহেল আর সম্রাটের আর কোনো খবর পেলাম না। যেদিন আমাদের ফেলে যায়, ওই দিনই পাশের চেম্বারে চোখ, হাত বাঁধা অবস্থায় শেষ কথা হয়েছে ওদের সাথে। আমি বিদায় নিয়েছিলাম সেহেল আর সম্রাটের কাছ থেকে। কিন্তু দেখতে পাইনি। সোহেল বলে দিয়েছিল, “ হয়তো আপনাকে ছেড়ে দেবে, আমার ৪ বছরের একমাত্র ছেলেকে দেখে রাইখেন”। আর কোনো কথা সোহেলের সাথে হয়নি। আর সম্রাটও দোয়া চেয়েছিল। বলেছিল, “ভাই দোয়া কইরেন, আমরাও যেন আপনাদের মতো ফিরতে পারি, আমাদেরকেও যেন জেলে পাঠায়”। কিন্তু আজও সোহেল, সম্রাটের কোনো খবর পেলাম না। ওদের লাশও পাওয়া যায়নি। জানি না ওরা বেঁচে আছে কি মরে গেছে। তবে, যেটাই হোক, যারা আমাদের তুলে নিয়েছিল, ওরাই সোহেল, সম্রাটের খবর জানে। মরে গেলে তারাই মেরেছে। আর বেঁচে থাকলে, ওদের কাছেই আছে। কথাগুলো বলছিলেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাবেক সহ-সভাপতি আনিসুর রহমান। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত গুম হয়েছিলেন তিনি।

মো. আনিসুর রহমান। ১৯৮২ সালের ১ মার্চ টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজোলায় জন্ম। বাবা মৃত হাজী আকরাম হোসেন, মা মৃত সুরাইয়া বেগমের তিন কন্যা ও একমাত্র পুত্র আনিস। নাগরপুর জদুনাথ পাইলট স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০০০ সালে মাধ্যমিক পাস করেন। নাগরপুর সরকারী কলেজ থেকে ২০০২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। কলেজে পড়ার সময়ে ২০০১ সালে নাগরপুর সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল সমর্থিত প্যনেলের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। পরিবারের বাঁধায় তখন পদ-পদবির প্রতি আগ্রহ দেখাননি। এইচএসসি পাসের পরই পারিবারিক ব্যবসায়ের কারণে ঢাকায় চলে আসেন। সেখানে বাবার সাথে বাংলাবাজারে প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসায় সহযোগী হন। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা আর চালাতে পারেননি। সূত্রাপুর থানায় ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও দীর্ঘদিন কমিটি না হওয়ায় কোনো পদ-পদবি পাননি। দীর্ঘদিন পর ২০১৮ সালে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। মাত্র তিন মাসের মাথায় ওই কমিটি ভেঙে গেলে মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সাথে সক্রিয়ভাবে রাস্তায় আছেন। দীর্ঘ ২৩ বছরের রাজনীতিতে গ্রেফতার হয়েছেন ২ বার। হামলার শিকার হয়েছেন অসংখ্যবার। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম হয়েছিলেন একবার। ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রী তামান্না তাসমিনের চিকিৎসার জন্য প্রায় চারমাস ধরে মুম্বাই টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে অবস্থান করছেন তিনি। আনিসুর রহমানের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন বাংলা আউটলুকের ঢাকা প্রতিনিধি।

 

বাংলা আউটলুক : রাজনীতিতে আসার কারণ কী?

আনিস : ১৯৭৯ সাল থেকেই আমাদের পরিবার পুরান ঢাকার বাংলাবাজারে থাকতো। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর, তাঁর সততা, দেশপ্রেম এবং সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসায় আকৃষ্ট হয়ে, আমার বাবা আকরাম হোসেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রচণ্ড অনুরাগী হয়ে পড়েন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর খবরে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। কয়েক দিন কেঁদেছেনও। বাবার মুখ থেকে জিয়াউর রহমানের নানান গল্প শুনে, সেই শৈশবেই এই নামটার প্রতি (জিয়াউর রহমন) আমার এক ধরনের ভাল লাগা কাজ করতো। মনে হতো, আমারা জিয়াউর রহমানেরই পরিবার। এই দলের সাথে থাকা আমার দায়িত্ব মনে হতো। আমার বাবা হাজী আকরাম হোসেন; শেখ মুজিব এবং জিয়াউর রহমানের দুই জনের শাসনামলের পার্থক্যের গল্প আমাদের ভাই-বোনদের বলতেন। তখন থেকেই বিএনপির প্রতি বা জিয়াউর রহমানের নামের প্রতি ঝুঁকে পড়ি। এর পর কলেজে গিয়ে ছাত্রদলের মিছিল মিটিং-এ অংশ নেওয়ার মাধ্যমে আমি বিএনপির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি।

বাংলা আউটলুক : দীর্ঘ দিন কোনো পদপদবী পাননি, তার পরও কেন এই দলের সাথে আছেন?

আনিস: আমার বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটি জিনিসই আছে। সেটি হচ্ছে এই বিএনপি ও জিয়াউর রহমানের আদর্শ। পদ-পদবী কখনো আমার কাছে প্রাধান্য পায়নি। দলের সাথে থাকতে পারাটাই আমার কাছে মুখ্য। দলের হয়ে চলমান অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলাটা আমার কাছে বাবার রেখে যাওয়া আদেশ মনে হয়েছে। তাই এই দলটির সাথেই আছি, শেষ পর্যন্ত থাকতে চাই।

বাংলা আউটলুক : এই দলের সাথে থাকতে গিয়ে কী কী সঙ্কটে বা বিপদে পড়েছেন?

আসিন : ১৯৯৭ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা যান। তার মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলে হিসেবে ব্যবসায়ের দায়িত্ব চলে আসে আমার কাঁধে। তখন এক-এগারোর দুঃশাসন চলছিল। ঢাকায় আসার পর থেকেই বিএনপির রাজনীতির সাথে সক্রিয় থাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজনের টার্গেটে পরিনত হই। বিভিন্নভাবে ব্যবসায়ে বাঁধা দিতে থাকে। ২০০৯ সালে আমি সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাথে সক্রিয় হয়ে পড়ি। এসময় আরো কষ্টকর হয়ে পড়ে টিকে থাকা। নানান সময়ে হামলা, পুলিশী অভিযানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেশির ভাগ সময়ে বন্ধ রাখতে হতো। ২০১২ সালের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন চরম ঘোলাটে হতে থাকে; আমার ওপরও নিপীড়ন বাড়তে থাকে। বহু সহকর্মী কারগারে আটকে পড়ে। নানান সময়ে নাজিমুদ্দিন সড়কের জেলে সেই বন্ধুদের খোঁজ খবর নিতে যেতে হতো। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর আমাকে নাজিমুদ্দিন সড়কের জেলগেট থেকে তুলে নিয়ে যায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

বাংলা আউটলুক : আপনার বিরুদ্ধে কি কোনো মামলা ছিল?

আনিস : না। প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের টার্গেটে পড়ি। কারণ, আমি সূত্রাপুর, কবি নজরুল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, গেন্ডারিয়া থানা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতাম। পুলিশী অভিযান থেকে রক্ষা পেতে আমার বাসায় তাদেরকে নানা সময়ে স্থান দিয়েছি। সেটিই কাল হয়ে দাঁড়ায়। আমাকে বহুবার আটকের জন্য টার্গেটও করেছে পুলিশ। কিন্তু পারেনি। আমিও বাসা থেকে বাইরে সরে যেতে বাধ্য হই। মূলত ২০১২ সাল থেকেই বাসার বাইরে থাকতে বাধ্য হই। কিন্তু কোনো মামলায় জড়ায়নি।

বাংলা আউটলুক : তারপরও আপনাকে কেন তুলে নিল?

আনিস : আমি জানি না। মূলত সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি খালিদ হাসান সোহেল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর টার্গেট ছিল। ওই দিন ওদের সাথে জেলগেটে ছাত্রদল কর্মী বিপ্লব, মিঠু এবং আমি ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল কর্মী কারাগারে থাকা সঞ্জয়ের সাথে দেখা করতে যাই। বৃহস্পতিবার দুপুর তখন দেড়টা বাজে। বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি চলছিল। সেখান থেকে আমাদের তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারীরা।

বাংলা আউটলুক : কীভাবে তুলে নিল?

আনিস : আমরা ছিলাম জেলখানার দশনার্থী টিকেট কাউন্টারে। আমাদের মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ জমা রেখে সঞ্জয়ের সাথে দেখা করার জন্য টোকেন নেই। পেছন থেকে ৪/৫ জন সাদা পোশাকে ঘিরে ফেললো। আমাদের নাম জানতে চাইলো। নাম বল্লাম। এর পর সম্রাট মোল্লার নাম শুনেই ওরা আমাদের কোমরের বেল্ট ধরে ফেললো। টেনে কাউন্টারের সাথেই সড়কে রাখা কালো রং-এর একটি হাইএস মাইক্রোতে ৫ জনকেই তুলে ফেললো।

বাংলা আউটলুক : গাড়িতে তুলে কী করলো?

আনিস : গাড়িতে বসিয়েই আমাদের পেছন দিক থেকে কালো টুপি দিয়ে মাথা-চোখ আটকে ফেলে। দুই হাত পেছনের দিক দিয়ে হাতকড়া পরিয়ে ফেললো। এরপর আর আমি ওদেরকে দেখতে পাইনি। শুধু কথা শুনে বুঝতে পেরেছিলাম, আমরা ৫ জনই এক গাড়িতে। আমাদের ২ জনকে মাঝখানে এবং সম্রাটসহ বাকি ৩ জনকে গাড়ির পেছনের সিটে বসায়। আমাদের দুই পাশে, সামনে পেছনে ওদের লোক বসা ছিল।

বাংলা আউটলুক : গাড়িতে বসিয়ে আপনাদের কিছু জিজ্ঞাসা করেছে?

আনিস : প্রথমেই আমাদেরকে কিল, ঘুষি এবং লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। পেছন দিক থেকে সম্রাটের প্রচণ্ড চিৎকার শুনতে পাই। ওদের কথায় বুঝলাম, সম্রাটের অণ্ডকোষ চেপে ধরেছে। আমাকেও মাথার পেছন দিক দিয়ে আঘাত করে। আমি আর কোনো শব্দ করতে পারিনি। আমার মাথার সামনের দিক কেটে গিয়েছিল। পালাক্রমে চলে তাদের এই নির্যাতন। আনুমানিক এক থেকে সোয়া এক ঘণ্টা গাড়ি চললো। এই পুরো সময়টা আমাদেরকেও নানা ধরনের নির্যাতন চালিয়েছে। শুধু সম্রাট এবং সোহেলকে আগের দিন ২৭ নভেম্বর সূত্রাপুরের একটি ককটেল বিস্ফোরণের সাথে জড়িত থাকার কথা শিকার করতে বলে। কিন্তু নির্যাতনে কেউ কোনো কথা বলতে পারছিল না।

বাংলা আউটলুক : আপনাদের কোথায় নিয়ে গেল?

আনিস : হঠাৎ গাড়ি থামলো। গোটা এলাকা নির্জন, নিস্তব্ধ। আমাদেরকে হাত ধরে গাড়ি থেকে নামালো। ১০ থেকে ২০ সেকেন্ড হাঁটিয়ে আমাদের মেঝেতে বসিয়ে দিল। তখনও আমরা ৫ জনই একসাথে আছি বলে মনে হয়েছে। কিন্তু কেউ কাউকে দেখছি না। কোনো সাড়াশব্দও নেই। মিনিট পাঁচেক পর হঠাৎ চিৎকারের শব্দ পেলাম। মনে হলো সম্রাটের চিৎকার। প্রায় ১০ মিনিট ধরে সম্রাটের উচ্চস্বরে চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলাম। চোখ এবং পেছনে দিক দিয়ে হাত বাঁধা। কিছুই দেখছি না। এর পর একে একে আমাদের প্রত্যেকের কান্না এবং উচ্চস্বরে চিৎকারের শব্দ শুনেছি। আমার পাশে বসা বিপ্লবের নাম জিজ্ঞাসা করে। দুই জনের পরই একজন আমাকে ধরে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। ৫ থেকে ১০ কদম হাটিয়ে একটি চেয়ারে বসায়। তখন আমার হাতকড়া খুলে দেয়। চোখ বাঁধা। আমার হাত এবং পা চেয়ারের হাতল এবং পায়ার সাথে শক্ত করে বেল্ট দিয়ে বেঁধে দেয়।

বাংলা আউটলুক : এর পর কী করলো?

আনিস : কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই আমার উরুতে, হাঁটুতে, কাঁধে, হাতের বাহুতে মোটা লাঠি দিয়ে জোরে ৭/৮টি আঘাত করে। ব্যথায় আমি চিৎকার দিয়ে উঠি। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “তুই পুলিশের ওপর বোমা মেরেছিস”- এটা স্বীকার করার জন্য চাপ দেয়। আমি চিৎকার দিয়ে বলি “এর সাথে আমি জড়িত না”। এরপর ২৫ বা ২৬ নভেম্বর যাত্রাবাড়িতে অন্য একটি বোমা হামলার দায় স্বীকার করার জন্য চাপ দেয়। আমি অস্বীকার করলে আমাকে প্রচণ্ডভাবে দুই পাশ থেকে দুই জন পেটাতে থাকে। ওরা মোট ৩ জন ছিল বলে মনে হয়েছে। ওদের কথাবার্তায় তারা ডিবি বা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্য কি না আমি বুঝতে পারিনি। তবে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এটা তাদের প্রশ্নের ধরনেই বুঝতে পেরেছিলাম। এভাবে আমাকে প্রায় পনের মিনিট পেটায়। আমি কোনো ঘটনার দায় স্বীকার করিনি। আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলি, “আপনারা অন্যায় করছেন, এসবের সাথে আমি জড়িত নই”। এর পর তারা পেটানো বন্ধ করে। 

বাংলা আউটলুক : এরপর কি অন্য কোথাও নিয়ে গেল?

আনিস : এর পর চেয়ার থেকে হাত-পা খুলে দিল। আবারো হাতকড়া পরালো। এবার সামনের দিকেই হাতকড়া লাগালো। আমি দাঁড়াতে পারছিলাম না। হাঁটতেও পারছিলাম না। ওরা দুই জন দুই হাত ধরে মিনিট খানেক হাঁটিয়ে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যায়। সেই কক্ষে লোহার গেট এবং পরে মোটা পর্দা লাগানো ছিল। আমার হাতে বেঁধেছে। আমাকে ধাক্কা দিয়ে কক্ষের মধ্যে ফেলে লোহার দরজায় তালা লাগিয়ে দিল। আতঙ্কে আমি আর নড়াচড়া করিনি। ওই কক্ষটি একটি কবরের মতো। তিন হাতের মতো চওড়া, আর ৭ ফুটের মতো লম্বা। মেঝেতে শুয়েই ছিলাম। কোনো বালিশ বা কাঁথা কিছুই ছিল না। হাতকড়া লাগানো, চোখ বাঁধা তাই ভাল ভাবে শুতেও পারছিলাম না। দিন কী রাত টের পাইনি। তবে, দীর্ঘ সময় পর, একটু শীত অনুভব করি। তখন মনে হয়েছিল, হয়তো ভোর রাত। শুয়ে থাকলেও ঘুম আসেনি। এরপর ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা পর হঠাৎ লোহার দরজার তালা খোলার শব্দ পেলাম। কোনো কথা বললো না। আমাকে ধরে তুললো।

বাংলা আউটলুক : তুলে কী করলো? 

আনিস : কক্ষ থেকে ৫ থেকে ১০ কদম হাঁটিয়ে পাশের একটি কক্ষে নিয়ে গেল। আমাকে মেঝেতে বসিয়ে দিল। ডান হাতের হাতকড়া খুলে দিল। ওই ব্যক্তিই হাত ধরে বেসিনে নিয়ে গেল। ওরাই পানির কল ছেড়ে দেয়, পানির নিচে হাত ধরে, আমি নিজেই হাত ধুই। আবারো নিয়ে মেঝেতে বসিয়ে দেয়। চোখ তখনও বাঁধা। ২ থেকে ৩ মিনিট পর একটি প্লেটে এক চামচের মতো কিছু ডাল দিয়ে মাখানো ভাত মুখের কাছে ধরে। একজন বলে, “এই নে খা”। আমি এক লোকমা মুখে দেয়ার পর আর খেতে পারিনি। গ্যাস্টিকের সমস্যার কারণে বুকে জ্বালা-পোড়া শুরু হয়ে যায়। আমি বলেছিলম, “আমাকে একটি গ্যস্টিকের ট্যবলেট দেয়া যাবে কি না”। জবাবে ওই ব্যক্তি বললো, “তোকে ট্যবলেট দিচ্ছি, বলেই আবারো হাত ধুইয়ে, হাতকড়া লাগিয়ে ওই কক্ষে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এসময় তারা একটি পানির বোতল এবং প্লাস্টিকের একটি কৌটা দিয়ে বলে, “প্রস্রাব আসলে এই কৌটায় সেরে নিস”। প্রায় ১০ ঘণ্টা পর আবারো বের করলো। এসময় প্রস্রাবের কৌটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেই বেসিনের পাশের একটি টয়লেটে নিয়ে পরিষ্কার করতে বলে। আমার চোখ বাঁধা ছিল, ওরাই আমাকে ধরে নিয়ে গেল। হাত ধোয়ার পর মেঝেতে বসিয়ে আবারো মাখানো ভাত দিল। এবারও সামান্য দুই তিন লকমা খেয়ে আর খেতে পারিনি। আবারো কক্ষে নিয়ে ফেলে দেয়। এভাবে দুই তিন বার বের করার পর একবার, হয়তো মধ্য রাত হবে, টের পেলাম পাশের কক্ষে মানুষের গোঙ্গানোর শব্দ। মনে হয়েছিল, ওটাই সম্রাট। এভাবে হয়তো দুই তিন দিন পর মনে হলো, একই কক্ষের মধ্যে চেম্বারের মতো, প্রত্যেক চেম্বারেই মানুষ আছে। 

বাংলা আউটলুক : তখন কী করলেন?

আনিস : ওদের কাছে আমি গ্যাস্টিকের ট্যবলেট চেয়েছিলাম। দুই তিন দিন পর আমাকে ওই চেম্বারে দিতে আসে। ট্যবলেট দিয়ে যাওয়ার পর, বিপরীত পাশ থেকে নাম ধরে ডাক দেয়। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। একটু পর আবারো নাম ধরে ডাকলো। ভয়ে ভয়ে আমি বললাম, “কে”। বিপরীত পাশ থেকে বললো, “আমি বিপ্লব”। এর পর পাশের কক্ষগুলোতে সোহেল, সম্রাট ওদের সাথেও হালকা শব্দে কথা হয়।

বাংলা আউটলুক : আপনারা যে কথা বলছেন, এটা ওরা টের পায়নি?

আনিস : আমি সামনের দিকের চেম্বারে ছিলাম। তাই বিপ্লব, সম্রাটদের সাথে দুই তিন দিন কথা বলার পর আমি ধরা পড়ে যাই। ওরা আমার চেম্বারের মধ্যেই লাঠি দিয়ে প্রচণ্ড মারধোর করে। আমিও পাল্টা প্রশ্ন করি। কেন আমাকে আটকে রাখা হয়েছে? কেন পরিবারের সদস্যদের জানানো হচ্ছে না? রেগে গিয়ে আরো পেটায়। আমি আহত হয়ে মেঝেতে পড়ে ছিলাম। কিন্তু বন্ধুদের সাথে কথা বলা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

বাংলা আউটলুক : এরপর কী হলো?

আনিস : এভাবে চলতে থাকে। দিন যায়, রাত যায়। আমরা পরস্পরের সাথে দেয়ালের এপাশ ওপাশ থেকে নানান বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম। আমাদের সবারই হাত, চোখ বাঁধা ছিল। আমরা সবাই-ই মেঝেতে পড়ে ছিলাম। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কত দিন হলো। গুনতে পারিনি। আমরা আলাপ-আলোচনা করছিলাম, হয়তো আমাদের ক্রসফায়ার দিয়ে মেরে ফেলবে। ওদের আচরণ এবং আমাদের ওপর নির্যাতনের ধরনে মনে হয়েছিল, আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে না। যে কোনো সময় এক এক করে নিয়ে যাবে। আট দশ দিন পর একজন সিনিয়র অফিসার বেশ মার্জিতভাবে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “তোর নাম কী আনিস?”। আগ্রহ নিয়ে আমিও আমার নাম বলি এবং বিনা কারণে অন্যায়ভাবে আমাকে ধরে আনা হয়েছে, বলে আমি ওই ব্যক্তির কাছে অভিযোগ করি। আমি ছাত্রদল করি, কিন্তু কোনো অন্যায়ের সাথে জড়িত না, বাংলাবাজারে আমার প্রকাশনা ব্যবসা আছে। এগুলো বলার পর, আমাকে আর কিছু বলেনি। আমার চোখ বাঁধা ছিল, তাই দেখতে পাইনি তিনি আছেন কি নেই। দীর্ঘক্ষণ কথা বলার পর, আর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভাবলাম, হয়তো তিনি চলে গেছেন। আবারো প্রতিদিন দুই বার করে আমাকে নিয়ে যেত, খাওয়াতো। এই দীর্ঘ সময়ে আমার একবারও টয়লেট হয়নি। এসময় আমাদের তুলে আনা পাঁচ জনের সাথেই আমরা নিচুস্বরে কথা বলতে পারতাম। আমাকে খাবার খেতে নিয়ে যাওয়ার সময় ওদের সাথে কান্না করেছি। একদিন রাগে-ক্ষোভে বুক পেতে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, “আমাকে গুলি করে ফেলেন, না হয় আমার পরিবারের কাছে খবর পাঠান, আপনারা আমাকে কেন তুলে এনেছেন?” এই সব শুনে ওদের একজন আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “তুই চিন্তা করিস না, তোকে ছেড়ে দেবে”।

বাংলা আউটলুক :  এরপর কি ছেড়ে দিল?

আনিস : না। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কবে ছাড়বে। আমাকে ধমক দিয়ে বললো, “বেশি কথা বলবি না, চুপ থাক”। এভাবে আরো ২ থেকে ৩ দিন চলে গেল। হঠাৎ একদিন তালা খুলে নিয়ে যায়, খাবার খেতে দিয়ে বলে, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে অনেক দুঃশ্চিন্তা করছিস, আজকে তোর শুভ দিন। আজকে তোকে ছেড়ে দেবে। আমি ওনাকে জড়িয়ে ধরি। তিনি আমাকে ধমক দিয়ে আবারো রিমান্ড কক্ষে নিয়ে গেলেন। মেঝেতে বসালেন। এর আগে অবশ্য কালো টুপি খুলে, মাথা নিচু করে, গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে দেয়। গামছার নিচ থেকে দেখতে পাই কক্ষের হালকা আলো এবং সামনে একজন লম্বা ফর্সা লোক চেয়ারে বসা। আমার অপর দুই বন্ধু বিপ্লব এবং মিঠুকেও ওই কক্ষে আনা হলো। আমরা সবাই মেঝেতে বসে আছি। আমি ওদের দেখতে পাচ্ছিলাম। বাকি দুই বন্ধু সোহেল এবং সম্রাট মোল্লাকে ওই কক্ষে আনা হয়নি, পাঁচজনের মধ্যে আমারা তিন জন বসে আছি। চেয়ারে বসা অফিসার আমাদের তিন জনের উদ্দেশ্যে বললেন, “বাবারে, দেখরে, তোরা রাজনীতি কেন করিস? এই নোংরা রাজনীতির কোনো দরকার নেই, বাবা-মায়ের সেবা কর, এই খানে যারা আসে, হাত-পা নিয়ে কেউ ফিরতে পারে না। তোদের ভাগ্য ভাল, বাবা মায়ের দোয়া আছে, এজন্য হয়তো তোরা ফিরে যেতে পারছিস”।  এ কথা বলছিল আর মোটা বেত দিয়ে আমাদের তিন জনকেই পেটাচ্ছিল, আমার শরীরের বিভিন্ন স্থান ফেটে গিয়েছিল। বিশেষ করে ঠোঁট, কান, দুই হাত- এগুলো সব ফেটে গিয়ে ছিল। আমরা তিনজনই উচ্চস্বরে চিৎকার করছিলাম। তিনি বলছিলেন, “আর রাজনীতি করার দরকার নেই”। আমি পিটুনি থেকে বাঁচতে বলেছিলাম, না আর রাজনীতি করবো না। তিনি বললেন, আজ তোদের ছেড়ে দিচ্ছি।

বাংলা আউটলুক : বাকি দুই বন্ধু সম্রাট এবং সোহেলকে কেন ছাড়া হচ্ছে না জানতে চাননি?

আনিস : হ্যাঁ। আমি প্রশ্ন করেছিলাম। কিন্তু আমাকে এজন্যও ওই কর্মকর্তা পিটিয়েছে। বলেছে, “ তোকে ছেড়ে দিচ্ছি, সেটাই তোর ভাগ্য, ওদের কথা তোর চিন্তা করার দরকার নেই। আমি বলেছিলাম, ওদের পরিবার আমাদেরকে প্রশ্ন করলে কী জবাব দেব? শুনে ওই কর্মকর্তা, আবারো বেধড়ক পেটায়। আমার হাত-পা ফুলিয়ে ফেলে। 

বাংলা আউটলুক : কীভাবে কোথায় ছাড়লো?

আনিস : আমি বলেছিলাম, স্যার আমাদের ছাড়লে তো আবারো পুলিশ ধরবে। তিনি বলেছিলেন, তোদের এমন জায়গায় ছাড়বো, পুলিশ তোদের ধরবে না। এরপর আমার প্যান্টের পেছনের পকেটে কিছু টাকা ওরাই ঢুকিয়ে দিল। হাতকড়া খুলে সামনের দিক দিয়ে গামছা দিয়ে শক্ত করে হাত বাঁধলো। চোখও গামছা দিয়ে বাঁধা। খালি পা। হঠাৎ সবাই চুপ হয়ে গেল। কোনো সাড়াশব্দ নেই। বুঝতে পারছিলাম, ওরা ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলেছে। আমার হাত ধরে একজন নিয়ে একটু হেঁটে গাড়িতে তুললো। আমার অপর দুই বন্ধুকেও গাড়িতে তুললো। সেটা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু সম্রাট আর সোহেলকে তোলা হলো না। ওরা রেখে দিয়ে দিল আমার দুই বন্ধুকে। আমরা অনুমান করতে পারছিলাম, ওরা র‌্যাব ছিল। গাড়ি চলতে থাকলো। শুরুর দিকের রাস্তা একটু ভাঙ্গা ছিল। এরপর সমতল রাস্তায় চলতে থাকলো গাড়ি। আনুমানিক ত্রিশ মিনিট গাড়ি চলার পর হঠাৎ কেউ একজন বাইরে থেকে গাড়ি থামালো। কিন্তু ভেতরের কেউ কোনো শব্দ করলো না। বাইরে থেকে বলা হয়েছিল, এই থামেন। দু’এক মিনিটের মধ্যে আবারো গাড়ি চলতে শুরু করলো। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে গাড়ি ব্রেক করলো।

বাংলা আউটলুক : আবার কেন ব্রেক করলো?

আনিস : সর্বোচ্চ ৫ সেকেন্ডের মধ্যে গাড়ির দরজা খুলে আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিল। আমি ব্যাঙের মতো সড়কের নিচের দিকে পড়ে যেতে থাকলাম। আমার হাত, চোখ গামছা দিয়ে বাঁধা। কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু গাড়িটি দ্রুত চলে যাওয়ার একটা শব্দ পেলাম। আমার অপর দুই বন্ধু বিপ্লব এবং মিঠুকেও একই সাথে ফেলে দিল। আমরা গড়িয়ে একজনের গায়ের ওপর একজন গিয়ে পড়লাম। বিপ্লব নিজেই মুখ দিয়ে ওর হাতের বাঁধন খুলে ফেলে। এর পর চোখের বাঁধনও খুলে ফেলে। রাত তখন একটা বা দুইটা বাজে। আশপাশে কোনো আলো ছিল না। কিন্তু হালকা চাঁদের আলো ছিল। বিপ্লব আমার হাতের এবং চোখের বাঁধন খুলে দেয়। একটু দূরে মিঠুও ছিল। মিঠু ওর নিজের হাত এবং চোখের বাঁধন নিজেই খুলেছে। আমরা তিনজন সড়কের ঢাল থেকে সড়কে উঠলাম। ভয়ে ঘুম ক্ষুধা বা অন্য কোনো চিন্তা মাথায়ই ছিল না। শুধু বেঁচে থাকার আন্দন্দ কতটুকু, তা ওই সময়ে টের পেয়েছি। মনে হলো, নতুন ভাবে জন্ম নিয়েছি। জায়গাটাও অপরিচিতি। কোথাও কিছু বুঝতে পারছিলাম না।

বাংলা আউটলুক : সেখান থেকে বাড়িতে ফিরলেন কীভাবে?

আনিস :  প্রধান সড়ক ধরে হাঁটতে থাকি। কিছু দূরে দেখতে পেলাম, পুলিশের একটি টহল গাড়ি। আতঙ্কিত হয়ে সড়কের নিচের দিকে নেমে যাই। পুলিশের গাড়ি থেকে হোই বলে চিৎকার দেয়। কিন্তু থামেনি। ওরা চলে যায়। আবারো রাস্তায় উঠি, কিছুদূর হেঁটে একটি শাখা সড়ক দেখতে পাই। সেই সড়তে ঢুকতেই একটি বাঁশের সাঁকো দেখি। পার হওয়ার চিন্তা করি। কিন্তু এরই মধ্যে পেছন দিকের প্রধান সড়কে একটি রিক্সা দেখতে পাই। আমরা থেমে যাই। রিক্সাচালককে হাত উঁচিয়ে অনুরোধ করি, সে আমাদের কাছে আসে। ছেড়ে দেয়ার আগে আমাদেরকে বলা হয়েছিল, “কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবি, আমাদেরকে ছিনতাইকারী নিয়ে গিয়েছিল”। তাদের শেখানো সেই কথাই বলি রিক্সাচালককে। প্রথমে ভয় পেলেও, আমাদের আকুতি দেখে পাশেই তার কুঁড়ে ঘরে আমাদের তিন জনকে নিয়ে গেল। আমাদেরকে বাঁশের চৌকির ওপর ঘুমাতে দেয়। কিন্তু আমরা না ঘুমিয়ে বসে থাকি। শেষ রাতের দিকে ওর বাবা আমাদের দেখে ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করে, “এই আপনারা কারা”?  আমাদেরকে তিনি চোর ভেবেছিলেন। আমরা বললাম, আমারা খুবই বিপদে পড়েছি, আপনার ছেলে আমাদের রাতের জন্য আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি মানতে নারাজ। আমরা প্রশ্ন করলাম, এই জায়গার নাম কী? তিনি বললেন, ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়কের নিমতলীর পাশ্ববর্তী কোন এক গ্রাম। সেই গ্রামের নাম এখন ভুলে গেছি। আমার বন্ধু বিপ্লবের মামা ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান; বিপ্লব এই পরিচয় দেয়। তখন রিক্সাচালকের বাবা কিছুটা শান্ত হন, এবং আমাদেরকে আশ্রয় দেন। মিনিট দু’য়েক পরে তিনি চলে যান। আমরা অবশ্য ওনার আচরণে কিছুটা ভয় পেয়ে যাই। এর কিছুক্ষণ পরই ফজরের আজানের শব্দ কানে আসে। আমরাও ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি।

বাংলা আউটলুক : ওখান থেকে বের হয়ে কোথায় গেলেন?

আনিস : আবারো প্রধান সড়কে উঠি। কিছুদূর পায়ে হাঁটি। সকালের আলো তখন প্রায় ফুটে উঠতে শুরু করেছে। কিছুটা দূরে আমরা একটি ব্রিজ দেখতে পাই। জায়গাটা দেখে বিপ্লব চিনে ফেলে। আমরা সাথে থাকা মিঠুকে সূত্রাপুরে পাঠিয়ে দেই। আমি আর বিপ্লব ওইখানে থেকে যাই।

বাংলা আউটলুক : এরপর কোথায় গেলেন?

আনিস : ব্রিজের ঢালে একটি রেস্তোরাঁ সবেমাত্র খুলছিল। আমরা গিয়ে তার কাছে কাঠের কয়লা চাইলাম। তা দিয়ে দাঁত মেজে পরিষ্কার করে নিলাম। সেই রেস্তোরাঁয় রুটি এবং সবজি দিয়ে সকালের নাস্তা করলাম। আমাদের কাছে ওদের দেওয়া (যারা তুলে নিয়েছিল) ৩’শ করে টাকা ছিল। দু’জনের মোট ৬’শ টাকা। বিপ্লবের নানীর বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলাম। পথেই একজন বিপ্লবকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। এরই মধ্যে সবাই আমাদের গুমের কথা জেনে গিয়েছিল। কিছুটা হেঁটেই আমরা বিপ্লবের নানীর বাড়িতে পৌঁছালাম। সেই বাড়িতে আমাদেরকে নিমপাতা, দুধ দিয়ে গোসল করালো। আমাদের চুলে জটা পড়ে গেছিল। গোসলের পর মনে হয়েছিল, পূনর্জন্ম পেলাম। আমাদেরকে মাছ, সবজি, ডাল দিয়ে ভাত খেতে দিল। অনেক দিন পর মনে হয়েছিল, ভাত খেতে পারছিলাম না। এরপরেও জীবনের সবচেয়ে তৃপ্তি সহকারে ওই দিনই খেলাম। এর মধ্যে বিপ্লবের নানীর বাড়ির লোকজন আমার বড় বোন আয়শা খাতুনকে ফোন দেয়। শুধু আমার বড় বোনের মোবাইল নাম্বারটাই আমার মনে ছিল।

বাংলা আউটলুক : আপনার পরিবারের লোকজন কী করলো?

আনিস : ফোন পেয়ে খুশিতে-কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আমার কথা বলতে গিয়ে বার মুর্ছা যাচ্ছিল। আমার বোন চিৎকার করে কান্না করছিল। বোন বললেন, “আমরা ভেবেছি, তোকে আর পাব না, আমরা তোকে খুঁজতে ঢাকা মেডিকেলের মর্গেও গিয়েছি, ঢাকা শহরের সবগুলো থানায় থানায় আমার স্ত্রী তামান্না তাসমিন গিয়ে কেঁদেছে” বলেও বোন জানালেন। এর ঘণ্টাখানেক পর সকাল ৯টার কিছু পরে আমার বড় বোন আয়শা এবং খালাতো ভাই তপন মিয়া সিএনজি নিয়ে বিপ্লবের নানীর বাড়িতে চলে আসেন।

বাংলা আউটলুক : বাড়িতে গিয়ে কি দেখলেন?

আনিস : সাড়ে নয়টার দিকে আমাকে নিয়ে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। বিপ্লব থেকে গেল ওর নানীর বাড়িতে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই সূত্রাপুরের বাসায় উঠলাম। গিয়ে দেখি, আমার স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন সবাই বাসায় জড়ো হয়ে আছেন। সবাই জড়িয়ে ধরে কান্নায়, খুশিতে ভেঙ্গে পড়েন। আমিও বেঁচে ফেরার আনন্দে অঝোরে কেঁদেছি। খবর পেয়ে সূত্রাপুর থানা পুলিশ, সাংবাদিকরা জড়ো হয়েছিল। চকবাজার থানা পুলিশও আমাকেসহ থানায় গিয়ে সাধারণ ডাইরি উঠিয়ে নিতে বলে। কিন্তু ভয়ে আমরা আর কেউই থানায় যাইনি। আমার পরিবারের সদস্যরা পরের দিনই আমাকে স্ত্রী সন্তাদেরসহ টাঙ্গাইলে নিয়ে যায়।    

বাংলা আউটলুক : এরপর কি চিকিৎসা করিয়েছিলেন?

আনিস : গ্রামে গিয়ে স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ব্যথার ওষুধ কিনে খেয়েছি। অবশ্য দলের নেতারা আমাকে চিকিৎসা করানোর জন্য হাসপাতালেও নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা আর কোথাও নিতে দেয়নি।

বাংলা আউটলুক : এখন কী অবস্থা?

আনিস : গুম থেকে ফিরে মাসখানেক পরই টাঙ্গাইল থেকে আবারো ঢাকায় ফিরি। দলের কার্যক্রমে আবারো সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে থাকি। এরই মধ্যে আমার স্ত্রী তামান্না, সে নিজেও ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটির সহ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন, ওর ব্রেস্ট ক্যন্সার ধরা পরে। আজও সেই চিকিৎসার জন্য আমি ভারতে অবস্থান করছি। আমার স্থাবর-অস্থাবর সবই প্রায় শেষ। ছেলেটা নটরডেম কলেজে একাদশ শ্রেনীতে পড়ছে। আর মেয়েটা সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়ছে। ওদেরকে দেশেই একা ঢাকার বাসায় রেখে এসেছি।

বাংলা আউটলুক : আপনারা পাঁচ জনের তিনজন ফিরলেন, কিন্তু বাকি দু’জনের খবর কী?

আনিস : আর কোনো খবর পেলাম না। যেদিন আমাদের ফেলে যায়, ওই দিনই পাশের চেম্বারে চোখ, হাত বাঁধা অবস্থায় শেষ কথা হয়েছে। আমি বিদায় নিয়েছিলাম সেহেল আর সম্রাটের কাছে। কিন্তু দেখতে পাইনি। সোহেল বলে দিয়েছিল, “ হয়তো আপনাকে ছেড়ে দেবে, আমার ৪ বছরের একমাত্র ছেলেকে দেখে রাইখেন”। আর কোনো কথা সোহেলের সাথে হয়নি। আর সম্রাটও দোয়া চেয়েছিল। বলেছিল, “ভাই দোয়া কইরেন, আমরাও যেন আপনাদের মতো ফিরতে পারি, আমাদেরকেও যেন জেলে পাঠায়”। কিন্তু আজও সোহেল, সম্রাটের কোনো খবর পেলাম না। ওদের লাশও পাওয়া যায়নি। জানি না ওরা বেঁচে আছে কি মরে গেছে। তবে, যেটাই হোক, যারা আমাদের তুলে নিয়েছিল, ওরাই সোহেল, সম্রাটের খবর জানে। মরে গেলে তারাই মেরেছে। আর বেঁচে থাকলে, ওদের কাছেই আছে।

বাংলা আউটলুক : ওদের কথা কী মনে পড়ে?

আনিস : সোহেল এবং সম্রাটের পরিবারের সাথে ফেরার পরে দেখা করেছি। কিন্তু কিছুই বলতে পারিনি। আজও ওদের শেষ কথাগুলো মনে পড়ে। তখন ঘুম, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। নিজের কথা মনে পড়লেও আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি।   

বাংলা আউটলুক : এরপরও কেন রাজনীতিতে আছেন?

আনিস : মৃত্যু ভয় আর করি না। মানুষের মুক্তির জন্য, সন্তানদের জন্য একটি সুন্দর পরিবেশের জন্য, শান্তির বাংলাদেশের জন্য লড়ছি। যতদিন বেঁচে আছি, সামনে থেকেই লড়াই চালিয়ে যাব।

বাংলা আউটলুক : আপনাকে ধন্যবাদ।

আনিস : বাংলা আউটলুককেও ধন্যবাদ। আমার মতো লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত মানুষের কথা তুলে ধরুন। সত্য প্রতিষ্ঠায় আপনারাও লড়াই চালিয়ে যান। বিজয় আসবেই।  

অনুসরণ করুন