বাঙালি মুসলমানের বড় অর্জন বাংলাদেশ

বাঙালি মুসলমানের বড় অর্জন বাংলাদেশ

ঔপনিবেশিক আমলে বাঙালি নিজেদের পুনর্জাগরণ হয়েছে বলে দাবি করে। ইউরোপের রেনেসাঁসের আদলে এই দাবি করলেও আদতে সেই পুনর্জাগরণ ছিল উঁচুজাতের হিন্দুর জাগরণেই সীমাবদ্ধ। নিচু জাতের হিন্দু বা মুসলমানের অংশগ্রহণ এতে ছিল না। এমনকি, এই পুনর্জাগরণ ছিল আদতে দখলদার ব্রিটিশের বশ্যতা মেনে নিজেদের লেখাপড়া আর চাকরি-বাকরির উন্নয়ন।

অনেক ঐতিহাসিক দাবি করেন যে, জাত-পাতের নির্মমতার বিরুদ্ধে নিজেদের মুক্ত করতেই এই অঞ্চলের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের একটা বড় অংশ ইসলাম ধর্মে আকৃষ্ট হন। মুঘলদের শাসনামলে শাসকের ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়েন বাংলার পূর্ব অঞ্চলের মানুষ, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন কৃষক।

কিন্তু, জাত-পাতে বিভক্ত উঁচুজাতের হিন্দুরা মুসলিমদের বাঙালি বলেই স্বীকার করতে চায় না। এমতাবস্থায়, ইংরেজের নাগপাশ থেকে মুক্ত হলেও বাঙালি মুসলমানের আত্মমর্যাদা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা হবে না বলেই সন্দেহ হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হয় বৃহৎ বাংলার পূর্বাঞ্চল।

কিন্তু, পাকিস্তান হবার পরেও তার মর্যাদা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা হয় না। মুখে ধর্মের ভাই বললেও পাঞ্জাবিরাও বাঙালিদের নিচুজাত হিসেবেই দেখতো। এমনকি, হিন্দু জমিদারদের বদলে মুসলিম জোতদাররা স্থলাভিষিক্ত হলে তারাও আশরাফ আর আতরাফে ভাগ করে দরিদ্র মুসলমানকে ছোট করে দেখা অব্যহত রাখলো।

বাঙালি মুসলমান আত্মমর্যাদার প্রশ্নে, নিজেদের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আবার বাধ্য হলো আন্দোলন সংগ্রামে। কেবল ধর্মের ভিত্তিতে ১২০০ মাইলের ব্যবধানের দুইটা অঞ্চল এক রাষ্ট্র হয়ে এমনিতেও থাকতে পারতো না। তবে, পাকিস্তানি শাসকদের আগ্রাসনে বহু মানুষের মৃত্যু এবং উচ্ছেদ হওয়ার পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।

শেষতক, নিজেদের একটা দেশ পেল বাঙালি। মজার ব্যাপার হলো, মুসলমান অধ্যুষিত যে অঞ্চলকে নিচু চোখে দেখতো পশ্চিম, তা সে বাংলাই হোক আর পাকিস্তান, তারাই একটা দেশ পেল, আত্মমর্যাদা পেল। এ এক বিরাট বিজয়। অন্যদিকে, উঁচু শ্রেণীর হিন্দুদের এতো জাত্যভিমানের পরও পশ্চিম বাংলা হয়ে রইলো হিন্দিভাষী ভারতের একটা রাজ্য মাত্র। ইতিহাসের এ এক দারুণ প্রতিশোধ।

প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কি কেবল বাঙালি মুসলমানের? অথবা এই স্বাধীনতায় কি মুসলমানের পরাজয় হয়েছে?

দুইটারই উত্তর না। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ যে আদর্শ নিয়ে হাজির হয়েছে তা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নয়। এই রাষ্ট্রের হক ধর্ম, মত নির্বিশেষে সবার। আর, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসনে যদিও অনেক মুসলমান শঙ্কিত, কিন্তু ঠিক এই কারণেই বাংলাদেশের মাহাত্ম্য আরো বোঝা যায়। এদেশ স্বাধীন না হলে বাঙালি মুসলমানের আত্মমর্যাদা ও অস্তিত্ব পড়তো মারাত্মক হুমকির মুখে।

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের সম্পত্তি ভাবে এবং এতে ভারতের সাহায্য থাকায় অনেকে হয়তো মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই গোস্যা করে ফেলেন। এই স্বাধীনতাকেই ভাবতে পারেন একটা ষড়যন্ত্র। কিন্তু ঘটনা ঠিক উল্টো।

একটা দল এই যুদ্ধের কৃতিত্ব চুরি করতে চাইলে তাকে না ঠেকিয়ে উল্টো মেহনতি মর্যাদার খোঁজে আত্মদান করা মানুষদের এই অর্জনকে ছোট করা মুর্খতা। এতে ওদেরই উল্টো বিজয় হয়। ওদের কথাই সত্যি হয়। উঁচুজাতের হিন্দুর শোষণে দমে না গিয়ে পূর্ববঙ্গের বাঙালি প্রমাণ করেছিল। ওরাই লড়াকু, ওরা লড়াই করে একটা দেশের জন্ম দিতে পারে। তেমনিভাবে, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ আর স্বাধীনতার প্রশ্নে হিস্যা অর্জন করে নিতে হবে।

স্বাধীনতার কৃতিত্ব এই দেশের খেটে খাওয়া মানুষের, এই অর্জন দারুণ এক গৌরবের।

মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার সামরিক কৌশল ও গেরিলা যুদ্ধ-দর্শনের প্রয়োগ পরবর্তী

মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার সামরিক কৌশল ও গেরিলা যুদ্ধ-দর্শনের প্রয়োগ

কমেন্ট

6090 Dawson Blvd, Suite H, Norcross, GA, United States, Georgia [email protected]