“মনে হয়েছে- মরে গেছি, আর পৃথিবীতে ফিরবো না আমি”

“মনে হয়েছে- মরে গেছি, আর পৃথিবীতে ফিরবো না আমি”

আমি আর সহ্য করতে পরছিলাম না; জেলখানার নির্যাতনে আমি বুঝতে পারছিলাম- “আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি”। আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, “আত্মহত্যা করবো”। কিন্তু তার আগে এই নির্যাতনের কথা বাইরের মানুষকে বলা প্রয়োজন। কিন্তু আমাকে তো বাইরে কিংবা জেলের ভেতরের কারো সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছিল না। টানা ৬ মাস আমাকে ফাঁসির আসামীদের সেলে আটকে রাখা হয়েছিল। কথা না বলতে না বলতে কথা বলাই ভুলে গিয়েছিলাম। দশ ফুট বাই পনের ফুট কক্ষের চার দেয়ালের মধ্যেই কেটেছে সময়গুলো। সেলের সামনে লিখে রেখেছিল, “রিপোর্টেড”। কেউ আমার সেলের সামনে দিয়েও হাঁটতো না। বহুবার দেয়ালে নিজের মাথা ঠুকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বাংলা আউটলুকের কাছে এভাবেই বর্ণনা করছিলেন তার সাথে ঘটে যাওয়া অবর্ণনীয় নির্যাতনের ঘটনাগুলো।

১৯৯৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলায় জন্ম বিন ইয়ামিন মেল্লার। কৃষক বাবা মো. রফিকুল ইসলাম মোল্লা এবং মা হাসিনা বেগমের দুই সন্তানের মধ্যে ছোট এবং একমাত্র পুত্র সন্তান বিন ইয়ামিন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ির সুন্নাহ টেংরা দাখিল মাদ্রাসা থেকে ২০১২ সালে দাখিল এবং উত্তরা রাজউক মডেল কলেজ থেকে ২০১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি। এর পর ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হন। ২০১৮ সালে স্নাতক শেষ হলেও নানান রাজনৈতিক মামলা-হামলার কারণে স্নাতকোত্তর এখনো শেষ করতে পারেননি । এখন ঢাবি’র লোকপ্রশাসন বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে অধ্যায়নরত বিন ইয়ামিন।

তার সাথে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক মামলা-হামলা এবং কারাগারের নির্যাতন নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বাংলা আউটলুকের ঢাকা প্রতিনিধির সঙ্গে।

বাংলা আউটলুক : রাজনীতিতে জড়ালেন কেন?

বিন ইয়ামিন : বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে আমি স্যার এফ রহমান হলে সংযুক্ত হলাম। আমরা যারা সাধারণ শিক্ষার্থী, তারা হলে থাকতে চাইলে ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিং এ যেতে বাধ্য করা হতো। এ বিষয়টি নিয়ে আমি প্রথম থেকেই ভীষণভাবে বিরক্ত হচ্ছিলাম। আমার তখন মনে হতো, এটা একটি দেশের জন্য অভিশপ্ত রাজনীতি। যে সময়টা একজন ছাত্রের পড়াশোনায় ব্যয় করার কথা, সেই সময়টা মিটিং-মিছিলের মধ্যে কেটে যাচ্ছে। আমি তখন থেকেই মনে মনে ভাবতাম, যদি এমন কোনো সুযোগ আসে, এমন কোনো আন্দোলন করার সুযোগ পাই, যার ফল সাধারণ মানুষ ভোগ করবে, যা ছাত্রদের জন্য হবে, তাহলে সেই আন্দোলন-সংগ্রামে যোগ দেব। এর পেছনেও একটি কারণ ছিলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে যেখানেই যেতাম, সাধারণ মানুষ সম্মান করতো, কিছু বলার জন্য অনুরোধ করতো, একটা সহজাত লিডারশিপের জায়গায় বসিয়ে দিত। মানুষের এমন সব ভালোবাসাই আমার মনে এক ধরনের আগ্রহ জন্ম দিয়েছিল। যদি সুযোগ পাই কিছু একটা করবো। ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কোটা সংস্কার অন্দোলনে ভূমিকা রাখার সুযোগ পাই। আন্দোলনের এক পর্যায়ে যখন নুরুল হক নুর, মো. রাশেদ খান, হাসান আল মামুন ভাইয়েরা আহত হয়ে কেউ হাসপাতালে আবার কেউ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে চলে গেলেন তখনই নেতৃত্বে চলে আসি। ধারবাহিকভাবে ডাকসু’র নির্বাচনেও আমরা অংশ নেই, আমাদের প্যনেলের প্রায় সবাই বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। যদিও ভিপি এবং সমাজসেবা সম্পাদক এই দুই পদেই আমাদের পক্ষে ফলাফল ঘোষণা করে, বাকি পদগুলো কেড়ে নেয়। সঠিক ফলাফল দেওয়া হয়নি।

বাংলা আউটলুক : এটি তো একটি আন্দোলন ছিল, রাজনৈতিক দল হিসেবে কোন প্রেক্ষাপটে আপনাদের আত্মপ্রকাশ?

বিন ইয়ামিন : আন্দোলনে সফলতা পেয়ে, আমরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সিনিয়র নেতাদের সাথে বসলাম। ভাবলাম, এখন আমাদের করণীয় কী? আমরা কি নিজেদের ক্যরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বো? কেউ ব্যাংকার হবো, কেউ কর্পোরেট হাই অফিসিয়াল হবো, কেউ বিসিএস ক্যডার হবো, কেউ ব্যবসায়ী হবো, কেউ শিক্ষক হবে? না কি আমরা ভিন্ন কিছু করবো? আমি তখন বললাম, দেখেন আমরা চাইলে অনেক কিছুই হতে পারবো। কিন্তু দেশটাকে যদি সত্যিকার অর্থেই উন্নত করতে চাই, তাহলে পেশীশক্তি এবং কালো টাকার রাজনীতি থেকে আমাদের মুক্ত করতে হবে। আমরা সব সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করি, কিন্তু আমাদের নিজেদেরই দায়িত্ব একটি মডেল ছাত্র সংগঠন এবং রাজনৈতিক দল গঠন করে সাধারণ মানুষকে আহ্বান জানানো। এই চ্যালেঞ্জটা আমরা নিতে পারি। ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে তারা নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল। আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম, নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে, আমাদের লাইফটা স্যাক্রিফাইস করে, দেশের জন্য রাজনীতি করবো। তখন থেকেই মূলত আমাদের রাজনৈতিক বীজটা বপন করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র অধিকার পরিষদ নামে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের ঘোষণা দেওয়া। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হই। সেই থেকেই আমাদের রাজনৈতিক স্বপ্নের বীজ বোনা। ধীরে ধীরে যুব সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন করি। এক পর্যায়ে সমাজের সিনিয়র সিটিজেনদের নিয়ে মূল দল গঠন করি। আমরা ছাত্ররা কেন রাজনৈতিক দল গঠন করলাম? এর পেছনেও বিভিন্ন পেক্ষাপট ছিল। সেই সময়ে দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো অন্যায়, অনিয়মের প্রতিবাদ করতে পারছিল না। আমরাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে মিছিল মিটিং করতে পারছিলাম। তখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, বুদ্ধিজীবীরা, বড় বড় সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদকরা আমাদের ডেকেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। সেই থেকেই মূলত রাজনৈতিক একটি ভিত তৈরি হয়ে যায়। আমরাও এগুতে থাকি।

বাংলা আউটলুক : এই পথটা কী সহজ ছিল?

বিন ইয়ামিন : না। তরুণ বয়সের সংগ্রামের জীবন, ছাত্র বয়সের এই উন্মাদনার এই পথটা মোটেই সহজ ছিলো না। পদে পদে নানান বাঁধা অতিক্রম করতে হয়েছে। হামলার শিকার হতে হয়েছে অসংখ্য বার। এখন আমার বিরুদ্ধে ১০টি মামলা চলছে। মাসে প্রায় ৭ থেকে ১০ দিন আদালতে হাজিরা দিতে যেতে হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় হামলা শিকার হয়েছি। চিকিৎসা নিয়েছি। ২০২০ সালে যখন মোদী বিরোধী আন্দোলন করি, সেই আন্দোলনের সময় আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আমাদের প্রায় ৫৬ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তখন আমি ৬ মাস জেলখানায় ছিলাম। তখন করোনা মহামারির কারণে লকডাউন চলছিল, কারো সাথে কোনো সাক্ষাৎ করার সুযোগ ছিল না। একাকীত্বের মধ্যে জেল খাটতে হয়েছে। এরপর আমি যখন ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হয়েছি, তখন ২০২৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে ঢাবি’র টিএসসিতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নৃসংশভাবে আমাদেরকে পিটিয়েছে। আমার মাথায় তারা জিআই পাইপ দিয়ে অসংখ্য আঘাত করেছিল। রক্তাক্ত করেছিল। আমার নাকে, মুখে মেরে ফুলিয়ে ফাটিয়ে দিয়েছিল। পেটে লাথি মেরেছিল। তারপরও আমি হাল ছাড়িনি। আমি বলেছি, আমার যদি মরে যেতেও হয়, রক্তে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ঘাস- রাজপথ যদি রঞ্চিতও হয়, আমাকে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা করা যাবে না। ছাত্র আন্দোলন থেকে আমাকে দূরে রাখা যাবে না।

বাংলা আউটলুক : টিএসসি’র হামলায় আপনার কী কী ক্ষতি হয়েছিল?

বিন ইয়ামিন : আমাকে রক্তাক্ত করার পর ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে পারিনি। পুলিশ আমাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেছিল; কিন্তু পারেনি। আমি গোপনে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলাম। ডা. জাফরউল্লাহ ফোন করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছিলেন, আমাকে গ্রেফতার করার জন্য যেন গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে পুলিশ না যায়। সেই যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রায় দুই সপ্তাহ (১৫ দিন) ভর্তি থেকেছি। তবে, মোদী বিরোধী আন্দোলনে আমাকে গ্রেফতারের সময় ট্র্যাপ করা হয়েছিল।

বাংলা আউটলুক : কি ট্র্যাপ করা হয়েছিল?

বিন ইয়ামিন : আমি তখন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের সাথে গুলশানে একটি মিটিং শেষ করে তার উত্তর বাড্ডার বাসায় যাচ্ছিলাম। আমাদের গাড়ির চালককে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কব্জা করে উত্তর বাড্ডায় ডেইলি শপিংয়ের সামনে নিয়ে গিয়ে হঠাৎ করে গাড়ির গেইট খুলে আমাদেরকে গাড়িতে তুলে নিতে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে। আমরা বুঝতে পেরে ওই শপিং মলে আমরা আশ্রয় নেই। কিন্তু ওখানেই আমাকে তারা মেরেছে, কিল ঘুষি দিয়েছে। একপর্যায়ে আমার হাতে তারা হাতকড়া পরিয়ে টেনে-হিঁচড়ে তাদের গাড়িতে তোলে এবং আমাকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেদিনই প্রথম করোনার লকডাউন চালু করা হয়।

বাংলা আউটলুক : ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে কী করা হলো?

বিন ইয়ামিন : তখন বাংলাদেশের তাপামাত্রা ছিল প্রায় ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমাকে যে গারদে রাখা হলো, সেখানে কোনো ভেন্টিলেটর বা জানালা ছিল না। কোনো ফ্যানও ছিল না। গারদ মানুষ দিয়ে ভর্তি ছিল। সেখানে মাদকাসক্ত, চোর, ডাকাত, দাগী অপরাধী ভর্তি। সেখানে বসার মতো জায়গাটুকুও ছিল না। প্রচণ্ড গরমে, মানুষের ঘামে মনে হয়েছিল- মেঝেতে অন্তত এক ইঞ্চি পরিমান ঘামের পানি জমে গিয়েছিল। আমাদেরকে সেখানে কয়েক দফায় রিমান্ডে নিয়ে আসা হয়েছিল। ১৭-২০ জনকে একবারে আনা হয়েছিল। দেখা যেত, আমরা কেউ শুতেও পারতাম না, বসতে পারতাম না। আমরা ৪-৫ জন দাঁড়িয়ে থাকতাম, একজনকে একটু এক ঘণ্টা বা আধাঘণ্টার জন্য শুয়ে বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতাম। মনে হতো, এই ডিবির গারদ হচ্ছে একটা জাহান্নাম।

বাংলা আউটলুক : শারীরিক নির্যাতন করেনি?

বিন ইয়ামিন : না। আমার কাছে প্রতিটি মুহূর্তই ছিল আতঙ্কের। মনে হতো- এই বুঝি নিয়ে যাবে, নির্যাতন চালাবে। এদিকে, গারদের ভেতরের পরিবেশটাও ছিল কষ্টের। মনে হতো, জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতনের জন্য নিয়ে যাওয়ার সময়টাতে একটু আলো বাতাস পেতাম। সেটুকুও বেশ শান্তির মনে হয়েছে। আমার মনে হতো- যদি রিমান্ডে নিয়ে যায়, তাহলে হয়তো একটু ঠান্ডা বাতাস পাবো।

বাংলা আউটলুক : রিমান্ডে নিয়ে কী করেছে?

বিন ইয়ামিন : কালো জমটুপির মতো টুপি মাথায় পরিয়ে দিত। হাতকড়া পরিয়ে উঁচু রডের সাথে হাত আধাঘণ্টা এক ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখা হতো। পা নিচে মাটির সাথে লাগতে দিত না। শুধু বৃদ্ধাঙ্গুলির ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করতো। হতাশ করে দিতে বলা হতো, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ৫০ টাকার জুতা পায়ে, দেড়’শ টাকার শার্ট পড়ে আসছো রাজনীতি করতে, দেশ বদলাতে।” আরো বলতো, “তোমার কী মামা-খালু আছে, টাকা-পয়সা আছে? এই যে গ্রেফতার হয়েছো, জেলে যাবা, কে দেবে টাকা পয়সা?” এই বলে অপমান করেছে। আমাকে তারা মোটা বেতের লাঠি দিয়ে আমার দুই হাত, দুই পায়ে পেটায়। দীর্ঘ সময়ের নির্যাতন সইতে না পেরে আমি কান্না শুরু করে দেই। আমি পড়ে যাই। পরে তারা আমাকে নানান বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বলে, তোমাদের এত লোক কোথা থেকে আসে? কে দেয় টাকা-পয়সা? আমেরিকান দূতাবাসসহ বিভিন্ন মিশনে যাতায়াত করার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

বাংলা আউটলুক : আর কিছু বলেনি?

বিন ইয়ামিন : পরের দিনগুলোতে হাতকড়া পরিয়ে, মাথায় জমটুপি পরিয়ে লোহার রডের সাথে ঝুলিয়ে রাখতো। বলতো, তোমাদের ফাঁসির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। আমরা যা বলি, সেটা বলে দাও, না হলে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। জীবন শেষ হয়ে যাবে। ওই দফায় প্রথমে ৩ দিন, এর পর ২ দিন এবং শেষে আরো ১দিন মোট ৬দিন রিমান্ডে নেয় ডিবি। একই ধরনের নির্যাতন চালায় আমার ওপর। সেবার দীর্ঘ ৬ মাস কারাভোগ করতে হয়েছে আমাকে।

বাংলা আউটলুক : এর পর কি আবারো গ্রেফতার হয়েছিলেন?

বিন ইয়ামিন : সর্বশেষ আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম ২০২৩ সালের ২ আগস্ট মধ্যরাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর ছাত্র ঐক্যের আহবান জানিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের একটি সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছিলাম। সেখানে স্টেপডাউন হাসিনা শ্লোগান দিয়েছিলাম। মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনাসহ সরকার পতনের ১ দফা কর্মসূচির সমর্থনে আমি ছাত্র ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলাম। এর আগে ৪/৫ মাস ধরে বাংলাদেশের সব ছাত্র সংগঠনের সাথে আলোচনা করেছি। ছাত্র সমাজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছি। ফ্যসিবাদ থেকে মুক্তির জন্য আমরা কী করতে পারি, এ নিয়ে আমি কাজ করছিলাম। এর পরই কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছিলাম। একই সময়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে টাঙ্গুয়ার হাওরে গ্রেফতারকৃত বুয়েটের ২৪ জন শিক্ষার্থীর মুক্তি, আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে হাফেজ কাউসারের হত্যার প্রতিবাদ ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের দমন পীড়নের প্রতিবাদে একটি সমাবেশ ঘোষণা করি। সেই কর্মসূচি ঘোষণার রাতেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আমাকে গ্রেফতার করে।

বাংলা আউটলুক : কোথা থেকে কীভাবে গ্রেফতার করে?

বিন ইয়ামিন : বাংলাদেশে যে প্রতিহিংসার রাজনীতি চলছে, তাতে আমাকে তারা গ্রেফতার করতেই পারে। কিন্তু আমার বৃদ্ধ বাবাকে আগে তারা গ্রেফতার করেছিল; আমি এটি জানতাম না। এটা পৃথিবীর কোথাও আছে কী না আমার জানা নেই। আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জামান টাওয়ারের নিচে বসে, আমাদের গণঅধিকারের কেন্দ্রীয় সভাপতি নুরুল হকসহ কয়েক জন নেতা-কর্মীর সাথে আলোচনা করছিলাম। হঠাৎই তিনটি হাইএস গাড়ি এসে আমার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে। আমি বুঝে ফেলি, আমাকে তারা গ্রেফতার করতে এসেছে। আমি কয়েক জনকে সাথে নিয়ে নুরুল হক নুরের গাড়িতে উঠে যাই। আমাকে তারা কিছু দূর অনুসরণ করে। ছবি তোলে। পরে চলে যায়। এর পর আমি নুরুল হকের বাসায় পৌঁছে যাই। কিছুক্ষণ পর আমার মা আমাকে ফোন দিয়ে বলে, “তোমার বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না”। আমি একটি সাধারণ পরিবারের সন্তান, এরকম পরিবারের কোনো সন্তান রাজনীতিতে জড়ালো বাবা-মা অনেক দুঃশ্চিন্তায় থাকে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার বাবাকে তারা তুলে নিয়ে গেছে। ওই বাসায় বসেই আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি লাইভ করে ছিলাম। কারণ, দুপুরেই একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে আমাকে কয়েকটি ম্যসেজ দেওয়া হয়েছিল, যেন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর লাফালফি না করি, সরকার বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি না করি। আমি যেন চুপ হয়ে যাই। আমি যদি থেমে না যাই, তাহলে আমার খবর আছে। তারা আমার আগের কিছু বক্তব্য কোট করে দিয়েছিল। আমাকে বলা হয়েছিল, আমি টাঙ্গুয়ার হাওরে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের পাঠিয়েছি, জাতীয় প্রেসক্লাবে কওমী ম্রাদাসার কয়েক’শ শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রোগ্রাম করেছি। তারা বলেছিল, “আমি দেশের ক্যম্পাসগুলো অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছি। আমি দুধর্ষ জঙ্গী প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত” এই বলে আমার ফোনে মেসেজ দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর সেই ম্যসেজটি আবার রিমুভ করে দেওয়া হয়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম- আমাকে, আমাদের নিয়ে, আমাদের দল নিয়ে কোনো চক্রান্ত হচ্ছে। আমাকে জঙ্গী হিসেবে উপস্থাপনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ঠিক তাই দেখলাম। মধ্যরাতে ডাকাতের মতো নুরুল হকের বাসায় তারা হানা দিল। আমরা ভেবেছিলাম ডাকাত বা অন্য কিছু। তারা বলেছে, জঙ্গি ধরতে এসেছি। আমাকে সেখানে মারা হয়েছে। মাথায় আঘাত করা হয়েছে। আমাকে হাতকড়া পরিয়ে পিঠে মারতে মারতে গাড়িতে তুলে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। পথে তারা আমাকে বলে, কী রাজনীতি করলা, নিজের জীবনটা শেষ করলা। বুঝবা এর পর কী মজা। বুঝবা কতদিন জেলে থাকতে হয়। আমি দেখলাম, গাড়ির পেছনে আমার বাবা বসে আছেন।

বাংলা আউটলুক : এরপর কী করলো?

বিন ইয়ামিন : আমি প্রচণ্ড অসুস্থ ছিলাম। আমার জ্বর ছিল। ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার পর ডিবির উপ-কমিশনার সাহেব ডেকে পাঠালেন। আমাকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। আমাকে ধরার জন্য আমার দুই সহকর্মী এবং আমার বাবাকেও গ্রেফতার করেছিল। কিন্তু পরে আমাকে রেখে তাদের ছেড়ে দেয়। পর দিন আমাকে কোর্টে পাঠায়, আমার জামিন হয়ে যায়। কিন্তু মুহূর্তেই পুরনো সেই মোদী বিরোধী আন্দোলনের মামলা নিয়ে আসে। সেই মামলায় ওয়ারেন্ট দেখিয়ে জেলে পাঠায়।

বাংলা আউটলুক : কারাগারে কী হয়েছিল? কেমন ছিল সেইসব দিনগুলো?

বিন ইয়ামিন : কারাগারে নেওয়ার পর আমাকে একদিন আমদানীতে, একদিন ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল। এর পরই জেলসুপার কেসটেবিলে ডেকে পাঠান। আমার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। একটু পরেই একজন এসে আমাকে বললেন, চলেন আমার সঙ্গে। আমি ভাবলাম আমার হয়তো অন্য কারাগারে চালান হয়ে গেছে। কিন্তু না। আমি দেখলাম, আমাকে সূর্যমুখী ভবনের নিচতলায় ১২ নম্বর সেলে ঢুকিয়ে দিলেন। আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারিনি। আশপাশের অন্য সেলের সব বন্দিদের প্রতিদিন সকাল বিকেল এক ঘণ্টা করে খুলে দেওয়া হতো। কিন্তু আমাকে বের হতে দেওয়া হচ্ছিল না। আমি জিজ্ঞাসা করলে, রাইটার আমাকে জানায়, ওপর থেকে অনুমতি নিতে হবে, তারপর আমাকে ছাড়া যাবে। এভাবেই সকাল গড়িয়ে বিকেল। সবাই বের হচ্ছে, হাঁটছে। তিন দিন পর জেলসুপার আসলেন। আমি জিজ্ঞাসা করি, কেন আমার সাথে এমন হচ্ছে। আমি সেলের বাইরে একটু হাঁটতে চাইলাম, লাইব্রেরিতে যেতে চাইলাম। কিছুই বললেন না। এরপর একদিন রাতে আমার সেলের সামনে জেলসুপার আসলেন। উনিও ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী, সেই দাবি নিয়ে একটু বের হতে চাইলাম। কিন্তু উনি আমাকে বললেন, থাক। আমার সাথে কাউকে কথাও বলতে দেওয়া হলো না। আমাকে একেবারে “সলিটারি কনফাইনমেন্টে” রাখা হলো। আমার সাথে কাউকে কোনো সাক্ষাৎ বা যোগাযোগ করতে দেয়া হতো না। আমাকে জেলসুপার বললেন, “দেখ তোমার ওপরে দুই পাশে সিসি ক্যমেরা আছে, তোমাকে ওপর থেকে নজরদারি করা হচ্ছে, আমি এখানে চাকরি করি, আমার কিছু করার নেই, যেভাবে আছো, সেভাবেই থাকতে হবে।”

বাংলা আউটলুক : আপনি কী এরপর আর চেষ্টা করেননি?

বিন ইয়ামিন : আমি আসলে বুঝতে পারলাম, আমি সেগ্রিগেশনের ভেতরে আটকা পরে গেছি। সেখানকার ইনচার্জ, রাইটারদের কাছে শুনে আস্তে আস্তে আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে আসলে কী শাস্তির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমাকে ২৪ ঘণ্টা লাকআপের ভেতরে রাখা হয়েছে। ১০ ফিট বাই ১৫ ফিট কবরের মতো ঘরে আমাকে ২৪ ঘণ্টা আটকে রাখা হতো।

বাংলা আউটলুক : সেই পরিস্থিতিতে কী মনে হয়েছে?

বিন ইয়ামিন : মনে হয়েছে, আমি মারা গেছি। কবরের ভেতরে আছি। পৃথিবীর কোনো মানুষের সাথে আমার যোগাযোগ করার সুযোগ নেই। পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে গেছি। সেই কক্ষের ভেতরে প্রচণ্ড মশা, ছারপোকা, চুলকানি। সূর্যের আলো-বাতাস সেখানে পাওয়া যায় না। কোনো রাতই আমি মশা, ছারপোকা, চুলকানির যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারিনি। আমাকে কোনো পিসি কার্ড দেয়নি। সেলের ওপরে তারা লিখে রেখেছিল, “রিপোর্ট”। এ ধরনের লেখা সাধারণত বড় ধরনের অপরাধীদের সেলের ওপর থাকে। ওই ভবনে সেই সময় বিভিন্ন বড় বড় বন্দিরা ছিলেন। সবাইকে একটু করে হাঁটতে দেয়া হতো। কিন্তু আমাকে সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করেছে। আমি সাধারণ একজন ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী।

বাংলা আউটলুক : আপনি আরো কী কী সমস্যায় পড়েছেন?

বিন ইয়ামিন : এভাবে থাকতে থাকতে একটা পর্যায়ে আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। মাঝে মধ্যেই মনে হতো, “আমি মারা গেছি”, “আমি আর পৃথিবীতে ফিরবো না”। ঘুম থেকে আমি উঠতে পারতাম না। কারণ, আমি তো আর হাঁটাচলা করতে পারতাম না। আমার শরীরের রগগুলো শক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমি দাঁড়াতে পারতাম না। ঘুমাতে চেষ্টা করলে, আমার মনে হতো, কালো রংয়ের কেউ এসে আমার গলা টিপে ধরছে, আমার পা ধরে কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একটা আতঙ্কজনক অবস্থা। ঘুমাতে পারছি না, আবার ঘুম ছাড়া থাকতেও পারছিলাম না। একটা সময় মনে হয়েছে, আমি চিৎকার চেঁচামেচি করি, দেয়ালে মাথা ঠুকে, মাথা ফাটিয়ে আমি মরে যাই। অথবা যে কোনোভাবে ফাঁসি দিয়ে আমি মরে যাই। আমি আর এই কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা নিতে পারছিলাম না। আর সহ্য করতে পারছিলাম না।

বাংলা আউটলুক : আর কোনো সমস্যা হয়েছিল?

বিন ইয়ামিন : আমি খুব সুন্দর করে গোছালোভাবে কথা বলতে পারতাম। কিন্তু এই দীর্ঘ দিন, মাসের পর মাস, নির্জন সেলে রেখে, মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। আমি কারো সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। আমি এখন কথা বলতে পারি না। আমার তোতলানো অবস্থা হয়ে গেছে। আমি কিছু মনে করতে পারি না। বা গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। অতীতের অনেক কিছুই স্মরণ করতে পারি না। আমার সাথে যে নির্যাতন হয়েছে, আশপাশের বন্দিরা আমার নির্যাতন দেখে কেঁদেছেন। আমার কাছে কাউকে আসতে দেওয়া হচ্ছিল না।

বাংলা আউটলুক : আপনি কী এসব কথা কারা কর্তৃপক্ষ বা অন্য কাউকে বলার চেষ্টা করেছেন?

বিন ইয়ামিন : একটা পর্যায়ে আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- আমি আত্মহত্যা করবো। ভাবলাম, এই কথাগুলো বাইরে বলা যায় কি না। আমি পারিনি। আমার বাবা-মা’র সাথে আমাকে প্রথম সাক্ষাৎ করতে দিয়েছিল এক মাস পরে। সেখানেও এসবি’র লোকজন ঘিরে রেখেছিল। ১৫ দিন পর পর সাক্ষাৎ করতে দিত, তাও শুধু বাবা-মা’র সাথে। আমি একদিন কোর্টে বসে একটা চিঠি লিখে বাবার পকেটে দিয়েছিলাম। আদালতে বলেছিলাম, আমার কিছু বলার আছে। আদালত বলেছিল, লিখিত দিতে হবে। হাইকোর্টে বলতে হবে। আদালত থেকে নামার সময় আমি আমার এক সহকর্মীকে কিছু বলার চেষ্টা করেছি। আমার সহকর্মী মামুনুর রশিদের ভিডিও ক্লিপে কিছু বলার চেষ্টা করেছি, পুলিশ আমার মুখ চেপে ধরে ছিল। অল্প একটু বলেছিলাম। যেটুকু বলেছিলাম, তাতেই বেশ আলোচিত হয়েছিল। এরপর এ ঘটনায় কেউ একজন উচ্চ আদালতে রিট করেছিল। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ তিনজন বিচারপতিকে ঘটনার পর্যবেক্ষণে পাঠানো হয়েছিল।

বাংলা আউটলুক : এরপর কি আপনাকে সেখান থেকে বের করে নিয়েছিল?

বিন ইয়ামিন : সেদিন যা ঘটেছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সেখান থেকে নিয়ে জেলখানার টাওয়ারে রাখে। টাওয়ারে সাধারণত দুধর্ষ অপরাধীদের হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়। সেটা ছিল রূপসা সেল। আমি রাইটারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে এখানে কেন আনা হলো। জবাবে রাইটার বলেছিল, আপনার জন্য বিচারপতিরা আসছে, এজন্যই আপনাকে ৬ তলায় রাখা হয়েছে। আপনার সাথে বিচারপতিদের দেখা হয়ে গেলে যদি বলে দেন। সে জন্যই ৬ তলায় আনা হয়েছে। বিচারপতিরা তো ৬ তলায় উঠবে না। এভাবেই আমাকে আড়াল করা হতো। আমাকে যখন কোর্টে আনা হতো, তখন আমার বাবা-মা বা আইনজীবীদেরও জানানো হতো না। জজ সাহেব আমার আইনজীবীর কথা জিজ্ঞাসা করলে, আমি কিছু বলতে পারতাম না। এর বাইরে একের পর এক মামলা দিয়েছে। একটায় জামিন হলে আরেকটা মামলা দিয়েছে। আমাকে চার চার বার জামিন থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। জেল গেটে বের হওয়ার জন্য আসলেই, বলা হতো আপনার পিডব্লিউ আছে। এভাবে আমাকে হয়রানি করা হয়েছে। এর পর প্রায় ৭ মাস পর ২৯ ফেব্রুয়ারি আমি জেল থেকে ছাড়া পাই।

বাংলা আউটলুক : কারামুক্তির পর চিকিৎসা নিয়েছেন? ডাক্তার কি বলেছে?

বিন ইয়ামিন : বের হওয়ার পর আমি বিএসএমএমইউতে সাইকিয়াট্রি, নিওরোলজি ও চর্ম রোগ বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছি। সাইকিয়াট্রি এবং নিউরোলজি বিভাগের চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাকে বলেছেন, আমি “পোস্ট ট্রমাটিক স্টেস ডিজঅর্ডার সাফারিং”-এ ভুগছি, আমাকে তারা কিছু ওষুধ দিয়েছেন। আমাকে কাউন্সিলিং নিতে হবে। এটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা। উন্নত চিকিৎসা ও কাউন্সিলিং না হলে সারা জীবন এই সমস্যাটা থেকে যেতে পারে। আমি কথা বলতে গেলে আটকে যাচ্ছি। বেশিক্ষণ কথা বললে কান গরম হয়ে যায়, ঘাড় মাথা গরম হয়ে যায়। আগে যে ভাবে আঙ্গুল উঁচিয়ে বক্তৃতা করতে পারতাম, আমি সেভাবে আর কথা বলতে পারি না। একটু কথা বললেই আমার মাথা ঘোরে, চোখ অন্ধকার হয়ে আসে, আমি পড়ে যাই। এই সমস্যাটাই আমি এখন ফেস করছি।

বাংলা আউটলুক : আপনাকে অন্য কোনো ভাবে নিপিড়ন করা হয়েছে?

বিন ইয়ামিন : আমি আসলে দুটো জিনিস আশঙ্কা করছি, আমাকে তারা যে ভাবে করে নির্যাতন করেছে, তারা একটা ইনট্রেট ইনস্ট্রাকশন বা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল অথবা আমি যেন পাগল হয়ে যাই সেই চেষ্টা করেছিল। আমাকে খাবারের সঙ্গে কোনো ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে কি না, সেই আশঙ্কাও করছি। আর একটা জিনিস, তারা আমাকে জেল থেকে মুক্তি দিলেও, আমাকে ছেড়ে দেয়নি। তাদের গ্রাস থেকে আমি মুক্তি পাইনি। আমাকে তারা যে কোনো সময় মেরে ফেলতে পারে।

বাংলা আউটলুক : এরপরেও কি রাজনীতি চালিয়ে যেতে পারবেন বা যাবেন?

বিন ইয়ামিন : যেহেতু একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছি। দেশপ্রেম ও সততা নিয়ে মানুষের জন্য লড়াইটা চালিয়ে যাব। আমাকে জেলে নির্যাতন চালানো হয়েছে আবার দলগতভাবে এবং আমার পরিবারকেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাকে অংশ নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। আমার বাবাকেও বিভিন্ন সূত্র থেকে ফোন দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আমি নির্বাচনে যেতে রাজি কি না। হয়তো, তাদের সেই অফার লুফে নিলে, আমার মামলা শেষ হয়ে যেত বা অনেকের মতো আমি ভাল জীবন যাপন করতে পারতাম। কিন্তু মানুষের ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে চাই। মানুষের ভালোবাসায় এই বিন ইয়ামিন মোল্লা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। সেই ভালোবাসা নিয়েই বাঁচতে চাই।

বাংলা আউটলুক : আপনাকে ধন্যবাদ।

বিন ইয়ামিন : বাংলা আউটলুককেও ধন্যবাদ, মানুষের মুক্তির সংগ্রামের সাথে থাকার জন্য।

     

                           

   

মরে যাবো নিশ্চিত হয়ে আমাকে হাসপাতালে ফেলে পুলিশ সরে যায় : সাজিদ হাসান পরবর্তী

মরে যাবো নিশ্চিত হয়ে আমাকে হাসপাতালে ফেলে পুলিশ সরে যায় : সাজিদ হাসান

কমেন্ট

6090 Dawson Blvd, Suite H, Norcross, GA, United States, Georgia [email protected]